Tuesday, September 29, 2015

বেতনক্রম নিয়ে ছোট আন্দোলন বড় সমস্যা

শ্যামল সরকার

৪ দিনেও গেজেট প্রকাশ না হওয়ায় অসন্তোষ বাড়ছে * লাগাতার কর্মবিরতিতে যাচ্ছেন প্রাথমিকের শিক্ষকরা * পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের কর্মবিরতি চলবে

সরকারের ঘোষিত অষ্টম বেতনক্রম নিয়ে অসন্তোষ দানা বাঁধছে। নতুন বেতনক্রমে বৈষম্য হয়েছে-এই অভিযোগ এনে ঈদের আগে বেশ কয়েকটি ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ আন্দোলন করেছে। ঈদশেষে তারা আবারও আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। যদিও এসব আন্দোলন এখনও বড় আকার পায়নি। তবুও বিষয়টিকে বেশ জটিল এবং বড় বলেই মানছে সরকারি পক্ষ। আর এ কারণেই সরকার এসব সমস্যা সমাধানের জন্য অর্থমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি মন্ত্রিসভা কমিটি গঠন করেছে। অবশ্য এ কমিটিতে অর্থমন্ত্রীকে রাখায় আপত্তি জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট বড় একটি পক্ষ। শিক্ষামন্ত্রী কমিটির ওপর আস্থা রাখতে সকলকে অনুরোধ জানিয়েছেন।

গত ৭ সেপ্টেম্বর নতুন বেতনক্রম ঘোষণা করা হলেও তা কার্যকর করতে প্রয়োজনীয় গেজেট এখনো প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। অর্থবিভাগ অবশ্য দাবি করছে যে, গেজেটের খসড়া প্রস্তুত আছে। অর্থমন্ত্রী আগামী ১৬ অক্টোবর দেশে ফিরবেন। অক্টোবরেই গেজেট প্রকাশের সম্ভাবনা আছে। গঠিত মন্ত্রিসভা কমিটি বিভিন্ন শ্রেণিপেশার দাবিগুলো বিবেচনা করে বেতন বৈষম্যের বিষয়টি নিরসন করলেই তখন গেজেট প্রকাশ করা হবে কিনা-এই প্রশ্নের জবাবে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গেজেট প্রকাশ না হলে বোঝা যাবে না কোথায় কোথায় সমস্যা। তার ধারণা এবার বেতনক্রম নিয়ে অসংখ্য মামলা-মোকদ্দমার উদ্ভব হতে পারে। আর সেরকম পরিস্থিতি হলে আগামী এক বছরেও নতুন কাঠামোতে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন পাওয়া যাবে কিনা সে নিয়ে অনিশ্চয়তা থেকেই যাবে।

বেতনক্রম ঘোষণার আগে গঠিত সচিব কমিটিতে দায়িত্বে থাকা একজন জ্যেষ্ঠ সচিব ইত্তেফাককে বলেছেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যেসব দাবি তা বেতনক্রম ঘোষণার আগেই সমন্বয় করা হয়। নতুন করে যেসব কথা বলা হচ্ছে তা সমন্বয় করা সম্ভব হলেও কঠিন হবে। এ সচিবের মতে বেতনক্রম থেকে সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল প্রত্যাহার করায় মূলত বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সমস্যার উদ্ভব হয়েছে। আর এ সমস্যা দূর করতে হলে পুনর্বহাল করতে হবে। শুধু বাত্সরিক প্রণোদনা (ইনক্রিমেন্ট) দিয়ে দাবির সঙ্গে সমন্বয় করা সম্ভব নয়। কারণ, যারা নতুন বেতনক্রমের বিরোধিতা করছেন, তাদের ঊর্ধ্বতন পদে পদোন্নতির সুযোগ কম। ক্ষেত্রবিশেষে এমন পদ রয়েছে যেখানে যোগদান করা হয় সেখান থেকেই অবসরে যেতে হয়। তারা সিলেকশন গ্রেড ও টাইমস্কেল প্রাপ্তিকেই পদোন্নতি বা মর্যাদার বলে বিবেচনা করেন। কারণ একজন মাঝারি গোছের কর্মকর্তা যে বেতন পান অবসরকালে তারা সে বেতনক্রম নিয়ে যেতে পারেন। এতে তাদের অবসর সুবিধাও বাড়ে। এটি সচিবালয় ও সচিবালয়ের বাইরে যারা এতদিন তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মকর্তা হিসাবে পরিচিত হতেন তাদের ক্ষেত্রে বেশি প্রযোজ্য। তবে সচিবালয়ের বাইরের কর্মচারীদের ক্ষেত্রে এর প্রতিক্রিয়া প্রকট। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সরকারি স্কুল কলেজ শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্যও সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল উপকারে লাগতো।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নো-ভ্যাট আন্দোলনের সফলতায় বেতনক্রম নিয়ে আন্দোলনরত পক্ষগুলো বেশ উত্সাহী হয়েছে। এখন তারা আন্দোলনের নতুন কর্মসূচি নির্ধারণ করতে ব্যস্ত রয়েছেন। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহেই কর্মসূচি চূড়ান্ত করে মাঠে নামছেন তারা। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, বিসিএস (আনসার), সরকারি কলেজ স্কুল, ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, প্রাথমিক বিদ্যালয়, সচিবালয় কর্মচারীরা এখন পর্যন্ত বেতনক্রম নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের মহাসচিব অধ্যাপক মাকসুদ কামাল বলেন, শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো ও স্বতন্ত্র পদমর্যাদা নির্ধারণ করাই আমাদের প্রধান দাবি। বেতন বৃদ্ধি আসল কথা নয়, প্রশ্নটি মর্যাদার। তাই বিদ্যমান বৈষম্য নিরসনের জন্য শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো নির্ধারণ করাই সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য সমাধান। আমলারাসহ বিভিন্ন পেশাজীবী সমাজের পৃথক বেতন কাঠামো রয়েছে। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকাসহ এশিয়ার অনেক দেশে শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতন কাঠামো রয়েছে। বাংলাদেশেও শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতন কাঠামো প্রয়োজন। তিনি জানান, বেতন ও পদমর্যাদা নিয়ে বৈষম্যের বিষয়ে সরকারের সাথে আলোচনা শুরু হয়েছে। দাবি বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন ও আলোচনা একসাথে চলবে। পরবর্তী কর্মসূচি গ্রহণের জন্য আগামী ৫ বা ৬ অক্টোবর বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সভা আহ্বান করা হবে।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সভাপতি অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, অষ্টম বেতন কাঠামোতে শিক্ষকদের অবজ্ঞা করা হয়েছে। এ জন্য অর্থমন্ত্রী দায়ী। তাই বেতন বৈষম্য নিরসন কমিটিতে তাকে রাখার বিষয়ে শিক্ষকদের আপত্তি রয়েছে।

তিনি বলেন, অষ্টম বেতন কাঠামোতে সিলেকশন গ্রেড বাতিল হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের সর্বোচ্চ ধাপে (গ্রেড-১) উন্নীত হওয়ার পথ বন্ধ হয়ে গেছে। দ্বিতীয় গ্রেডের পর তাদের বেতন বাড়লেও প্রথম গ্রেডে তারা যেতে পারবেন না। এ ছাড়া নিয়মিত ২০টি গ্রেডের বাইরে মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও মুখ্য সচিব এবং জ্যেষ্ঠ সচিবদের জন্য দুটি বিশেষ গ্রেড থাকায় অধ্যাপকদের মর্যাদা আগের তুলনায় কমবে। আমলাতোষণ করে যে বেতন কাঠামো তৈরি হয়েছে তাতে শিক্ষকদের অধিকার ও মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়েছে।

সরকারি কলেজ: সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল বাদ দেয়ার প্রতিবাদে আন্দোলনে মাঠে রয়েছে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতি। কর্মসূচির অংশ হিসাবে ইতিমধ্যে সারাদেশে দুই দফা কর্মবিরতি পালন করেছেন তারা। আগামী ৭ অক্টোবর তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মানববন্ধন করবেন। এছাড়া ১৪ ও ১৫ অক্টোবর ক্লাস বর্জন কর্মসূচি দেয়া হয়েছে। শিক্ষকরা বলছেন, ঘোষিত পে-স্কেলে শিক্ষা ক্যাডারে গ্রেড কয়েক ধাপ নামিয়ে দেয়া হয়েছে। এছাড়া সিলেকশন গ্রেড বাতিল করায় শিক্ষকরা আরও বৈষম্যের শিকার হবেন।

সরকারি মাধ্যমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়: বেতন বৈষম্য কমানোসহ ৭ দফা দাবিতে কর্মসূচি পালন করেছে সরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। বেতন গ্রেড ১১তম ধাপে পুনর্নির্ধারণসহ ১১ দফা দাবিতে কঠোর আন্দোলনের হুমকি দিয়েছেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা। প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকদের দাবি না মানার শেষ তারিখ আজ। দাবি মানা না হলে অক্টোবর থেকে লাগাতার কর্মসূচি দেয়ার হুমকি রয়েছে তাদের।

এছাড়া প্রধান শিক্ষকদের জন্য ঘোষিত দ্বিতীয় শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তার পদমর্যাদা বাস্তবায়ন করা ও জাতীয় বেতন স্কেলের ১০ম গ্রেডে অন্তর্ভুক্তকরণসহ পাঁচ দফা দাবিতে কর্মসূচি রয়েছে। প্রধান শিক্ষক সমিতির নেতা আলাউদ্দিন মোল্লা জানান, প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দেয়ার দেড় বছরেও প্রধান শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদা ও বেতন স্কেল দেয়া হয়নি। ৮ম বেতন কাঠামোতে ১০ম গ্রেডে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে তাদের।

৮ম বেতন কাঠামোতে সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল পুনর্বহাল, প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদা বাস্তবায়ন, ১০ গ্রেডে প্রধান শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্ত করাসহ বিভিন্ন দাবিতে লাগাতার কর্মবিরতির হুমকি দিয়েছেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। বাংলাদেশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির আহ্বায়ক রিয়াজ পারভেজ বলেন, দেশের সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আগামী ৩ থেকে ৫ অক্টোবর সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত কর্মবিরতি পালনের কর্মসূচি রয়েছে তাদের। আগামী ৬ অক্টোবর থেকে লাগাতার কর্মবিরতির ঘোষণা রয়েছে।

বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মচারী সমিতি:স্মারকলিপি দেয়ার মাধ্যমে বেতনক্রমে তাদের অসন্তুষ্টির কথা প্রকাশ করে আসছে সচিবালয় কর্মচারীরা। তারা অবশ্য একটু গা-ঢাকা ভাবে কর্মসূচি পালন করে আসছে। তারাও টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড পুনর্বহালের পক্ষে।

ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন: প্রতিষ্ঠানের সভাপতি একেএম আব্দুল হামিদ ইত্তেফাককে বলেন, প্রায় ৬০ হাজার ডিপ্লোমা প্রকৌশলী সরকারি চাকরিতে আছেন। অষ্টম বেতন স্কেলে তারা বেতন বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। ইনস্টিটিউশনের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে বেতন বৈষম্য দূর করার জন্য সরকারকে এক মাসের সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়েছে।

Published in: http://www.ittefaq.com.bd/national/2015/09/30/37785.html

মেডিকেলের প্রশ্ন ফাঁস অসুখ হলে সর্বনাশ

মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার

বর্তমান পৃথিবীতে শিক্ষাক্ষেত্রে নৈরাজ্য আছে এমন দেশগুলোর কোনো সূচক আছে কি-না জানি না। তবে যদি থাকত, তাহলে চোখ বুজে বলে দেয়া যেত, বাংলাদেশের অবস্থান ওই সূচকে থাকত সর্বোচ্চ পর্যায়ে। কারণ, নানারকম বিভাজন এবং বিভিন্ন দুর্নীতি বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনকে নৈরাজ্যপূর্ণ করে রেখেছে। শিক্ষাঙ্গনে আজ সমস্যার পাহাড়। এসব সমস্যার মধ্যে শিক্ষা খাতে স্বল্প বাজেট বরাদ্দ, শিক্ষক নিয়োগে দলীয়করণ ও দুর্নীতি, শিক্ষাঙ্গনের রাজনীতি ও সন্ত্রাস, যোগ্য শিক্ষকের অভাব, শিক্ষক প্রশিক্ষণের অপর্যাপ্ততা, শিক্ষকদের অপর্যাপ্ত বেতন, শিক্ষকদের দায়িত্বশীলতার অভাব, গবেষণা ক্ষেত্রে স্বল্প বরাদ্দ, শিক্ষকদের ক্লাস ফাঁকি, ছাত্র-শিক্ষকদের দলীয় রাজনীতি, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অত্যধিক মুনাফা অর্জন, উচ্চ শিক্ষাঙ্গনে সুশাসনের অভাব, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে হল দখল, সিট বাণিজ্য, ভর্তি বাণিজ্য, বড় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পদে পদে ১৯৭৩-এর অধ্যাদেশ ভাঙা, ছাত্র ও শিক্ষকদের মান কমে যাওয়া, বাড়তি উপার্জনের জন্য শিক্ষকদের কোচিং করা ও অন্যত্র পাঠদান, ভর্তি পরীক্ষায় ডিজিটাল ফ্রড ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এতসব সমস্যার মধ্যে ঘন ঘন প্রশ্নপত্র ফাঁস সাম্প্রতিককালে সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি যে হাল আমলের সমস্যা, এমন নয়। বর্তমান সরকার বা মহাজোট সরকার আমলের আগেও এ সমস্যা ছিল। এরশাদ সরকারের সময় দশম বিসিএস পরীক্ষা প্রশ্ন ফাঁসের কারণে স্থগিত করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে এ সমস্যা থাকলেও তা কয়েক বছর পরপর শোনা যেত। তবে মহাজোট আমল থেকে এ সমস্যাটি একটি নৈমিত্তিক সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় এবং পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ঘন ঘন ফাঁস হতে থাকে। এ ঘটনা শিক্ষাঙ্গনের পরীক্ষায় সীমাবদ্ধ না থেকে তা প্রায় সব প্রতিযোগিতামূলক কর্মকর্তা নিয়োগের পরীক্ষায়ও সংক্রমিত হয়।


মহাজোট আমলে এবং বর্তমান সরকারের সময় প্রতিবছর বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। এর মধ্যে ছিল প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা (পিএসসি) থেকে শুরু করে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষা, এইচএসসি, অনার্স প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষাসহ বিভিন্ন ভর্তি পরীক্ষা, শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা, ব্যাংক কর্মকর্তা নিয়োগ পরীক্ষা এবং বিসিএসের মতো গুরুত্বপূর্ণ সব পরীক্ষা। ফলে প্রশ্নপত্র ফাঁসকারী চক্রের সদস্যরা এ সরকারের আমলে জমজমাট ব্যবসা করেছে। প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার পর প্রতিটি প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা তদন্তের জন্য গতানুগতিক ভঙ্গিমায় তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে এবং ধীরে ধীরে তা এক সময় চাপা পড়ে গেছে। সরকার প্রশ্নপত্র ফাঁসকারীদের দ্রুততার সঙ্গে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে না পারায় প্রশ্নপত্র ফাঁসকারীরা আশকারা পেয়ে আবারও এ বিনা পুঁজির লাভজনক ‘ব্যবসায়’ জড়িত হয়েছে।

২০০৯ সালের জানুয়ারিতে মহাজোট সরকার গঠিত হওয়ার পর ২০১০ সালে সরকারি মাধ্যমিক স্কুলে সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। এ প্রশ্ন ফাঁসকারী সিন্ডিকেট প্রতি চাকরিপ্রার্থীর কাছ থেকে ৫ থেকে ৮ লাখ টাকা দরে প্রশ্ন বিক্রয় করে কোটি কোটি টাকা সংগ্রহ করে। রংপুর পুলিশ ওই সময় এ ঘটনায় জড়িত ১৬৭ জনকে গ্রেফতার করে তাদের কাছ থেকে ৬৮ লাখ টাকা উদ্ধার করেছিল। প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার কারণে ২০১২ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠেয় ৩৩তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। বিসিএস প্রশ্নপত্র ফাঁসকারীরা প্রশ্নপত্রের ৯টি বিষয়ের সেট পরীক্ষার্থীদের কাছে ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা দরে বিক্রয় করে। এ প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের কিছু নেতা, কতিপয় বিজি প্রেস কর্মকর্তা এবং জনৈক পিএসসি কর্মকর্তা জড়িত ছিল বলে গোয়েন্দা সংস্থা সন্দেহ করেছিল। ২০১৩ সালের মে মাসে অগ্রণী ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা পদে নিয়োগের জন্য পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার আগেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হলে কর্তৃপক্ষ ওই পরীক্ষা বাতিল করে দেয়। একই বছর ডিসেম্বরে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা প্রশ্নপত্র ফাঁসের কারণে বাতিল করা হয়। তবে ওই পরীক্ষা পুনরায় অনুষ্ঠানের সময় কোনো কোনো জেলায় আবারও প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়।

২০১৩ সালের নভেম্বরে ফাঁস হয় জেএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র। এ প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনাটি বোর্ড কর্তৃপক্ষ স্বীকার না করলেও যে প্রশ্নে পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়, তার সঙ্গে ফাঁস হওয়া প্রশ্নের হুবহু মিল পাওয়া যায়। জেএসসিকে অনুসরণ করে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও ফাঁস করে চড়া দামে বিক্রি করা হয়। একই বছর এপ্রিলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হলে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর ফাঁসের ঘটনা স্বীকার করে এবং বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে প্রশ্নপত্র ফাঁসকারীদের ৬০ জনকে গ্রেফতর করে। পরবর্তীকালে ২০১৪ সালের এপ্রিলে ঢাকা বোর্ডের এইচএসসি পরীক্ষার ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের প্রশ্নপত্র ফাঁস হলে ওই পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও মাঝে মধ্যে ফাঁস হয়েছে। এ বছর ২০১৫ সালে হল মেডিকেলের প্রশ্নপত্র ফাঁস। এর আগে ২০১১ সালে ৩০ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদপুর ও শ্যামলী থেকে মেডিকেলের প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে র‌্যাব ২১ জনকে গ্রেফতার করে মামলা করলেও তাদের একজনকেও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা সম্ভব হয়নি। এই ২১ জনের একজন এ বছর মেডিকেল প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে ১৫ সেপ্টেম্বর আবারও র‌্যাবের হাতে আটক হয়। প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ এনে মামলা হওয়ার দৃষ্টান্ত থাকলেও শাস্তির দৃষ্টান্ত নেই। গত ৬ বছরে প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইনে ৭০টি মামলা হলেও এসব মামলায় কারও শাস্তি হয়নি। কাজেই প্রশ্নপত্র ফাঁসকারীরা আশকারা পাবে এটাই স্বাভাবিক। এবার কোরবানির ঈদের ছুটি শেষ হওয়ার কিছুদিন পর থেকেই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা শুরু হবে। জানি না ওই ভর্তি পরীক্ষাগুলোর প্রশ্নপত্র ফাঁস হবে কি-না। তবে গত দু’বছর বিভিন্ন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় ডিজিটাল ফ্রডকারীরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না পাওয়ায় এ বছর জরুরি ভিত্তিতে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ না করা হলে ওই ভর্তি পরীক্ষাগুলোয় ডিজিটাল ফ্রড বাড়তে পারে।

এভাবে গত ৬-৭ বছরের প্রশ্নপত্র ফাঁসের ধারাবাহিকতা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রশ্নপত্র ফাঁস যেন ক্রমান্বয়ে একটি নৈমিত্তিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। কোনো নিয়োগ বা ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হলে রেওয়াজ অনুযায়ী একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় এবং ধীরে ধীরে বিষয়টি একসময় স্তিমিত হয়ে যায়। অথবা, পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইনে একটি মামলা হয় এবং ওই মামলায় অভিযুক্তদের কাউকে শাস্তি দেয়ার মতো অপরাধ খুঁজে পাওয়া যায় না। এটাই যেন আজ নিয়মে পরিণত হয়েছে। প্রশ্নপত্র ফাঁসকারী সিন্ডিকেটগুলো অত্যন্ত শক্তিশালী হওয়ায় তাদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা যায়নি। ফলে এরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে বিনা পুঁজির এ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে এবং কোটি কোটি টাকা উপার্জন করছে। প্রশ্নপত্র ফাঁসকারী সিন্ডিকেটের অনেক সদস্যের নাম পত্রিকায় প্রকাশিত হলেও পুলিশ তাদের খুঁজে পায় না। অথচ এই পুলিশই সুড়ঙ্গ খুঁড়ে ব্যাংকের ভল্ট ভেঙে টাকা চুরি করে পালিয়ে যাওয়া চোরদের ২-৩ দিনের মধ্যে গ্রেফতার করতে পারে। আমাদের পুলিশ-র‌্যাবকে যথাযথ নির্দেশনা দিলে তারা প্রশ্নপত্র ফাঁসকারীদের ধরতে পারবে না, এমনটা বিশ্বাস করা যায় না।

মেডিকেলের প্রশ্নপত্র যে ফাঁস হয়েছে, খতিয়ে দেখলেই এর সত্যতা অনুধাবন করা যায়। যারা পরীক্ষার্থী তারাই এ ব্যাপারে সবচেয়ে বড় বিশেষজ্ঞ। তারা বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছে বলেই আন্দোলনে নেমেছে। সরকারও খতিয়ে দেখলে হয়তো বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারবে। প্রশ্নপত্র ফাঁস না হলে পরীক্ষা চলাকালে ইউজিসিতে অভিযান চালিয়ে র‌্যাব ৩ জনকে গ্রেফতার করত না। পরীক্ষার আগের দিন ১৭ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মহাখালী থেকে ৪ জনকে আটক করত না। রংপুরে ৩ চিকিৎসকসহ ৭ জনকে আটক করত না। আদালত আটককৃতদের রিমান্ড মঞ্জুর করত না। পরীক্ষায় ২ হাজারের বেশি পরীক্ষার্থী ৮০ থেকে ৯০-এর ঘরে নম্বর পেত না। টিআইবি এ পরীক্ষা বাতিল করতে বিবৃতি দিত না। ইতিমধ্যে ভর্তি পরীক্ষা বাতিলের দাবিতে আন্দোলনকারী সাধারণ পরীক্ষার্থীরা রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলা শহরে শান্তিপূর্ণ মিছিল, সমাবেশ ও মানববন্ধন করেছে। আন্দোলনকারীরা তো তাদের মেডিকেলে ভর্তি করে নিতে বলছে না, তারা স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনায় ফাঁসমুক্ত প্রশ্নপত্রে ভর্তি পরীক্ষা দিতে চাইছে। এ দাবি অত্যন্ত ন্যায্য। ইতিমধ্যে তাদের দাবির প্রতি বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন, সুশীল সমাজের গণ্যমান্য সদস্য এবং কিছু রাজনৈতিক দল সমর্থন দিয়েছে। আন্দোলনকারীরাও তিন দিনের আলটিমেটাম দিয়ে কঠোর আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছে। এ অবস্থায় সরকারের উচিত এ বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ভ্যাটবিরোধী আন্দোলনের মতো মেডিকেলে ভর্তিচ্ছু ছাত্র-ছাত্রীদের রাজপথে নামতে বাধ্য করে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করার পর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত হবে না।

এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, যত রকম প্রশ্ন আজ পর্যন্ত ফাঁস হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক হল মেডিকেল ও ডেন্টালের প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া। এ কথা বলার অর্থ এই নয় যে, মেডিকেল বাদে আর যেসব ক্ষেত্রে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে সেগুলো ক্ষতিকর নয়। তবে বিদেশে ওই সব শিক্ষার্থীই কেবল মেডিকেল ও ডেন্টালে ভর্তি হতে পারে, যারা স্কুল ফাইনালে সবচেয়ে বেশি নম্বর পায়। অস্ট্রেলিয়ায় যাদের গড় নম্বর থাকে শতকরা ৯৮ বা ৯৯, তারাই কেবল মেডিকেল ও ডেন্টালে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়। অন্যান্য উন্নত দেশেও মেডিকেলে ভর্তির ক্ষেত্রে এমন সতর্কতা অবলম্বন করা হয়। এটা খুবই যুক্তিসঙ্গত। কারণ, যারা মেডিকেলে ভর্তি হবেন, তারাই ডাক্তার হয়ে মানুষের চিকিৎসায় মনোনিবেশ করবেন। তাদের হাতেই নির্ভর করবে মানুষের জীবন। তারা যদি যোগ্য, দক্ষ না হন এবং নির্ভুল সিদ্ধান্ত দিতে না পারেন, তাহলে মানুষের জীবন বিপন্ন হবে। বাংলাদেশ সরকারেরও উচিত মেডিকেলে ভর্তির বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা। মেডিকেল ও ডেন্টালের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের ব্যাপারে সামান্যতম সন্দেহ থাকলে ওই পরীক্ষা বাতিল করে শতকরা ১০০ ভাগ স্বচ্ছতা সুনিশ্চিত করে আবারও পরীক্ষা গ্রহণ করে সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের মেডিকেল ও ডেন্টালে পড়ার জন্য নির্বাচিত করা উচিত। নয়তো ফাঁস করা প্রশ্নে যারা উচ্চ নম্বর পেয়ে মেডিকেল বা ডেন্টালে পড়ে পরবর্তীকালে ডাক্তারি করবে, তারা যে মানুষ মারা ডাক্তার হবে সে কথা আগে থেকেই বলে দেয়া যায়। ভুলে যাওয়া উচিত নয়, প্রশ্নপত্র ফাঁসকারীদের প্রশ্রয়দাতারাও কোনো না কোনো দিন অসুস্থ হবেন। তাদেরও ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। কাজেই আজ যদি কেউ এ প্রশ্ন ফাঁসকে প্রশ্রয় দেন, তাহলে একদিন বৃদ্ধ বয়সে হয়তো তাদেরই আজকের ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রে পাস করা হাতুড়ে ডাক্তারদের ভুল চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করতে হবে।


ড. মুহাম্মদ ইয়াহইয়া আখতার : অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
akhtermy@gmail.com

Published in: http://www.jugantor.com/window/2015/09/30/330032

শিক্ষকদের দাবি কি অযৌক্তিক?

ড. ইকবাল হোসেন

শিক্ষকদের দাবি সম্পর্কে জনসাধারণকে সঠিকভাবে অবহিত করার প্রয়োজন রয়েছে। কেননা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এদেশের জনসাধারণের জন্যই। আর তা পরিচালিতও হয় জনসাধারণের দেয়া অর্থের জোগানে। দাবিগুলো নিুরূপ :
ক. পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা, খ. শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো বাস্তবায়িত না হওয়া পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে ঘোষিত অষ্টম বেতন কাঠামোর বৈষম্য নিরসন করে সিলেকশন গ্রেড অধ্যাপক আর সিনিয়র সচিবদের একই গ্রেডভুক্ত করা। অতঃপর ক্রমান্বয়ে ও সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে অধ্যাপক, অধ্যাপক (প্রারম্ভিক), সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক ও প্রভাষকদের গ্রেড নির্ধারণ করা, গ. জাতীয় বেতন কাঠামোর গ্রেডের ভিত্তিতে ওয়ারেন্ট অফ প্রিসিডেন্সে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপকদের অবস্থান পুনর্নির্ধারণ করা, ঘ. প্রযোজ্য ক্ষেত্রে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদেরও গাড়ির সুবিধার আওতাভুক্ত করা।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের এসব দাবি সম্পর্কে কৌশলে এক ধরনের ভুল ধারণা ও ব্যাখ্যা ছড়ানো হচ্ছে। সুতরাং বিষয়টি জনসাধারণের জন্য স্পষ্ট হওয়া দরকার।

প্রথমত, স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ শ্রীলংকা ও পাকিস্তানসহ বিশ্বের স্বল্প, মধ্যম ও উচ্চ আয়ের অনেক দেশেই রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো। এদেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদেরও দীর্ঘদিনের চাওয়া একটি স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো। বর্তমান সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্র“তিতেও বলা হয়েছিল শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর কথা। স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো যে শিক্ষকদের একটি ন্যায্য চাওয়া, তার প্রমাণ দেখা যায় আমাদের নতুন জাতীয় শিক্ষানীতিতে। জাতীয় নতুন শিক্ষানীতিতে এদেশের সর্বস্তরের শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রণয়নের কথাই বলা হয়েছে। কাজেই স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো আজ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের নতুন কোনো চাওয়া নয়, বরং এটি দীর্ঘদিন ধরে বয়ে আসা এক অপ্রিয় অপূর্ণতা।

দ্বিতীয়ত, অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা হিসেবে অষ্টম বেতন কাঠামোর বৈষম্য দূরীভূত করা। শিক্ষকরা মনে করেন স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন একটি সময় সাপেক্ষ কাজ। তাই স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষকদের বেতন-ভাতা জাতীয় অষ্টম বেতন কাঠামোর মাধ্যমেই হতে পারে। তবে তার আগে অষ্টম বেতন কাঠামোর সব বৈষম্য অবশ্যই দূর করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে পূর্ববর্তী সপ্তম বেতন কাঠামোকে রেফারেন্স হিসেবে নেয়া বাস্তবসম্মত। কেননা সপ্তম বেতন কাঠামো ছিল ভারসাম্যমূলক ও সবার কাছেই গ্রহণযোগ্য।

আশ্চর্যজনকভাবে অষ্টম জাতীয় বেতন কাঠামোতে, চলমান ভারসাম্য বিনষ্ট করা হয়েছে কেবল একটি শ্রেণীর স্বার্থে। অষ্টম বেতন কাঠামোতে জাতীয় গ্রেডবহির্ভূত বিভাজন সৃষ্টিকারী ও বৈষম্যমূলক পৃথক দুটি সুপার গ্রেড সৃষ্টি করা হয়েছে। যার প্রথমটি নির্ধারণ করা হয় মুখ্য ও মন্ত্রিপরিষদ সচিবদের জন্য। আর অপরটি রাখা হয় মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবদের জন্য। সভ্যতার এ যুগে এসে, একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রে, নতুন করে রাষ্ট্রের সমপর্যায়ের পেশাজীবীদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টিকারী ও বৈষম্যমূলক এসব সুপার গ্রেডের প্রতি এদেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বিন্দুমাত্র সমর্থন নেই। বরং শিক্ষকরা মনে করেন, বিভাজন সৃষ্টিকারী ও বৈষম্যমূলক এসব সুপার গ্রেড এদেশের সংবিধানের পরিপন্থী। কাজেই শিক্ষকদের চাওয়া, সুপার গ্রেডগুলো অনতিবিলম্বে বাতিল করা হোক। আর জাতীয় গ্রেড-১ই হোক শীর্ষস্থানীয় গ্রেড।

তৃতীয়ত, ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদাক্রমে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপকদের অবস্থান। রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদাক্রমে জাতীয় বেতন কাঠামোর গ্রেড-১ এর অন্তর্ভুক্ত একজন সচিব রয়েছেন ১৬তম অবস্থানে, আর গ্রেড-২ এর অতিরিক্ত সচিবের অবস্থান ১৯তম। অপরদিকে সপ্তম বেতন কাঠামো অনুসারে গ্রেড-১-ভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সিলেকশন গ্রেড অধ্যাপকরা রয়েছেন ১৯তম অবস্থানে, যেখানে অবস্থান করছেন তাদের নিুতর গ্রেডভুক্তরা। সুতরাং একই গ্রেডভুক্ত জনপ্রশাসন কর্মকর্তা থেকে এদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেকশন গ্রেড অধ্যাপকরা পিছিয়ে আছেন তিন ধাপে। এটা কি শিক্ষকতা পেশার অবমূল্যায়ন নয়? স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদাক্রমে কোনো রাষ্ট্রীয় পেশাজীবীর অবস্থান নির্ধারণের সমীকরণটি তাহলে কী? এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের ব্যাখ্যা প্রদান করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। বেশির ভাগ অধ্যাপকই এ ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স সম্পর্কে অনাগ্রহী। তারা অর্পিত নয়, বরং অর্জিত সম্মান ও মর্যাদায় বিশ্বাসী। এমন এক সময় ছিল, শিক্ষকদের মানুষজন পণ্ডিত নামে ডেকে থাকতেন। পণ্ডিতরা ছিলেন সমাজের বিশেষ সম্মানিত ব্যক্তি। তাদের সেই সম্মান ও মর্যাদা ছিল সম্পূর্ণভাবেই নিজেদের কর্ম-জ্ঞান-সাধনা আর জীবন আদর্শ-দর্শন দ্বারা অর্জিত, অর্পিত নয়। পরিবর্তিত এ যুগে অন্যান্য পেশার মতো শিক্ষকতা পেশায়ও এসেছে অনেক পরিবর্তন ও আদর্শগত চ্যুতি-বিচ্যুতি। তবে আলোকিত দক্ষ মানবসম্পদ গঠনের গুরুদায়িত্ব কিন্তু এখনও একমাত্র এ শিক্ষকতা পেশায়ই ন্যস্ত রয়েছে। আজও এদেশের বেশির ভাগ শিক্ষক শুধু এ শিক্ষক পরিচয়েই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে থাকেন, তারা অন্য কোনো অর্পিত পদবি বা সম্মানের লোভী নন। নিজেদের কর্মস্থলই তাদের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণস্থান। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের চাওয়া, রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদাক্রমে শিক্ষকদের অবস্থান সম্মানজনক হোক, অন্যথায় তাদের ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স থেকে সরিয়ে নেয়া হোক। সমাধানটি কিন্তু একেবারেই সহজ।

সর্বশেষ, প্রযোজ্য ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদেরও গাড়ির সুবিধার আয়ত্তভুক্ত করা। গ্রেড-৩ এবং তদূর্ধ্ব জনপ্রশাসন কর্মকর্তারা অফিসিয়াল কাজে সরকারি অফিস-গাড়িই ব্যবহার করে থাকেন। পাশাপাশি তারা ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কাজে ব্যবহারের জন্য, গাড়িক্রয় বাবদ এককালীন ৩০ লাখ টাকা করে স্বল্প সুদে লোন পেয়ে থাকেন, যা থেকে শুধু ২০ লাখ টাকা তারা পরিশোধ করে থাকেন। আর গাড়ি চালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ গ্রেড-৩-ভুক্ত একজন কর্মকর্তাই প্রতি মাসে পেয়ে থাকেন ৪৫ হাজার টাকা। এ সুবিধা একমাত্র জনপ্রশাসন কর্মকর্তা তথা আমলাদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, এই রাষ্ট্র কি শুধু আমলাদের দ্বারাই পরিচালিত হয়? শিক্ষক ও ২২ লাখ কর্মকর্তা-কর্মচারী সবারই ভূমিকা রয়েছে এ রাষ্ট্র পরিচালনায়। তাহলে আমলারা কেন বৈষম্যমূলক এ অতিরিক্ত সুবিধা নেবেন? আশ্চর্যজনকভাবে এবার জনপ্রশাসন কর্মকর্তাদের গাড়ির সুবিধা গ্রেড-৩ থেকে বাড়িয়ে গ্রেড-৬ এ নিয়ে আসার জোর চেষ্টা চালানো হয়। যেখানে গ্রেড-১ভুক্ত হয়েও সিলেকশন গ্রেড অধ্যাপকরা রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনা করে গাড়ির সুবিধা চাওয়া থেকে বিরত ছিলেন, সেই একই রাষ্ট্রীয় অবস্থায় কী করে গ্রেড-৪, ৫, ৬-ভুক্ত আমলারা গাড়ির সুবিধা চাওয়ার কথা চিন্তা করে? একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হিসেবে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা আর শিক্ষকতা পেশার ঐতিহ্য/অবদান বিবেচনা করে এ বিষয়ে শিক্ষকরা হয়তো তাদের সর্বোচ্চ ছাড়ই দিয়ে থাকবেন।

শিক্ষকদের প্রতিটি পদে নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে রয়েছে সুনির্দিষ্ট নিয়ম ও নীতিমালা, যা কিওটি নামে পরিচিত। আর প্রতিটি কিওটি-ই বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক অনুমোদিত। নিয়োগ/পদোন্নতির ক্ষেত্রে সিলেকশন বোর্ড (এসবি) যথাযথভাবেই কিওটি অনুসরণ করে থাকেন। ক্ষেত্র বিশেষে কোনো কোনো পদ যথা সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক পদে নিয়োগ/পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রার্থীর আবেদনপত্র বিদেশে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মূল্যায়নের জন্য পাঠানো হয়ে থাকে। বিদেশী বিশেষজ্ঞদের মূল্যায়নে সন্তোষজনক ফলাফল এলেই কেবল এসবি অনুষ্ঠিত হয়। আর এসবি সুপারিশ অবশেষে পাঠানো হয় সিন্ডিকেটে অনুমোদনের জন্য। ভিসি ও শিক্ষক প্রতিনিধির পাশাপাশি সিন্ডিকেটে থাকেন চ্যান্সেলর অর্থাৎ মহামান্য রাষ্ট্রপতির প্রতিনিধি এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি। কাজেই শিক্ষকদের যে কোনো পদে নিয়োগ/পদোন্নতির ক্ষেত্রে কোনোরকম অনিয়ম হয়ে থাকলে তা সিন্ডিকেটে বাতিল হওয়ার শতভাগ সুযোগ/সম্ভাবনা রয়েছে।

বলা হয়ে থাকে, এদেশে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা অন্যান্য দেশের তুলনায় খুব সহজে পদোন্নতি পেয়ে থাকেন। এটি সত্য, বিশ্বের মধ্যম ও উচ্চ আয়ের দেশগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের পদোন্নতির জন্য যেসব গবেষণা শর্ত/রিকুয়ার্মেন্ট নির্ধারিত থাকে, তার চেয়ে আমাদের শর্ত কিছু ক্ষেত্র-বিশেষে অনেক অংশে সহজতর। তবে যারা শুধু এ যুক্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের পদোন্নতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেন, তাদের প্রতি পরামর্শ থাকবে, আপনারা উচ্চশিক্ষা বিশেষ করে গবেষণা খাতে বিনিয়োগ নিয়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে আমাদের একটি পরিমাণগত তুলনা তৈরি করুন আর ভাবুন এদেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের পদোন্নতির শর্ত কী হওয়া উচিত।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের গবেষণা সক্ষমতা ও কার্যক্রম নিয়ে নেতিবাচক তথ্য ছড়ানো হচ্ছে। দায়িত্ব নিয়ে বলব, এদেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের গবেষণা সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন করা হবে এক বড় ধরনের অজ্ঞতার পরিচায়ক। কেননা শিক্ষকদের বেশিরভাগই বিশ্বের উচ্চমানসম্পন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে আন্তর্জাতিক শিক্ষা-গবেষণা মানদণ্ড যথার্থভাবে পূরণের মাধ্যমে উচ্চতর ডিগ্রি সম্পন্ন করা। এদেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা Nature Index, H Index, Total Citation, Citation Per Publication ইত্যাদি আধুনিক ও প্রচলিত গবেষণা মানদণ্ড সম্পর্কে অবগত। তারা Elsevier, ACS, Wiley, Springer, and Taylor & Francis ইত্যাদি প্রকাশকের নানা হাই-ইমপ্যাক্ট জার্নালে রেফার্ড আর্টিকেল প্রকাশনাতে অভিজ্ঞ। তারা Scopus, SciFinder ইত্যাদি সার্চিং টুলস ব্যবহারে সিদ্ধহস্ত। Times Higher Education World University Ranking, QS World University Ranking, and Shanghai Academic Ranking of World Universities সম্পর্কেও তারা সচেতন। শিক্ষকরা নিজস্ব প্রচেষ্টায় নানা বিষয়ে গবেষণা এখনও ধরে রেখেছেন। পাবলিকেশনও হচ্ছে আন্তর্জাতিক জার্নালে। বিশেষ করে কম্পিউটেশনাল কাজে ভালো পাবলিকেশন দেখা যাচ্ছে। তবে প্রয়োজনীয় হারে আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা যে এদেশে হচ্ছে না, তা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা অকপটে স্বীকার করে থাকেন। গবেষণার জন্য থাকতে হবে প্রয়োজনীয় উপকরণ। জ্বালানি ছাড়া যেমন কোনো গাড়ি চালানো সম্ভব নয়, তদ্রুপ প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ ছাড়া মানসম্পন্ন গবেষণা অসম্ভব। এটি খুব সরল একটি এন্যালজি, সংশ্লিষ্ট সবাইকে বুঝতে হবে।

পরিশেষে আশা করব, সরকার দ্রুত দেশ, জনসাধারণ ও আগামী দিনের স্বার্থে শিক্ষা খাতের বিশেষ গুরুত্ব অনুধাবন করবে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ন্যায্য পদমর্যাদা ফিরিয়ে দেবে। শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রণয়নে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করে চলমান আন্দোলনের সমাপ্তি এনে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থিতিশীলতা আনবে।


ড. ইকবাল হোসেন : সহকারী অধ্যাপক, কেমিকৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়

Published in: http://www.jugantor.com/window/2015/09/30/330033

আরো পড়ুনঃ 
"স্বতন্ত্র স্কেল চাই, অন্য কোন দাবি নাই!!"
আমলাতন্ত্রের আমলনামা ও শিক্ষকদের অবমূল্যায়ন
সংস্কারের বিকল্প নেই
ঔপনিবেশিক জনপ্রশাসন এবং ক্যাডার সার্ভিস সংস্কার
ক্যাডারের রাজা "প্রশাসন ক্যাডার"
শিক্ষার ঋণে আনন্দভ্রমণ!

৮ম পে-স্কেল ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অসন্তোষের কারণ

এমএম রহমান

সরকার সম্প্রতি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ৮ম পে-স্কেল ঘোষণা করেছে। এ পে-স্কেল সব স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মূল-বেতন প্রায় দ্বিগুণ করার ঘোষণা দেয়া হলেও প্রজাতন্ত্রের অধিকাংশ চাকরিজীবীদের মাঝে এ পে-স্কেল ব্যাপক ক্ষোভ, অসন্তোষ ও হতাশা সৃষ্টি করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) ২৬টি ক্যাডার, সরকারি মাধ্যমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকম-লী ক্ষুব্ধ হয়েছেন এবং ইতোমধ্যে তারা আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। তাদের ভাষায় এ পে-স্কেল অতীতের যে-কোন পে-স্কেলর তুলনায় বৈষম্যমূলক, অসম্মানজনক ও অতিমাত্রায় আমলাবান্ধব।সরকারকে এ পে-স্কেল বাস্তবায়ন করতে বেতন-ভাতা খাতে সরকারকে প্রচুর টাকা খরচ করতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও এ-ব্যাপারে যথেষ্ট আন্তরিক। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন সরকার ২০০৯ সালে ৭ম পে-স্কেল ঘোষণা করলে তখন এরূপ অসন্তোষ দেখা দেয়নি। তাহলে এ পে-স্কেলকে কেন্দ্র করে শিক্ষক ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে কেন এত অসন্তোষ ও ক্ষোভের সৃষ্টি হল তা খতিয়ে দেখা দরকার।এ অসন্তোষের কারণ অনুসন্ধানে জানা যায় যে, ৮ম পে-স্কেল টাইমস্কেল এবং সিলেকশন গ্রেড বাতিল করাই মূল কারণ। এই ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বোঝানো হয়েছে যে, টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড চালু থাকলে বেতন-ভাতার হিসাবে বিশাল জটিলতা সৃষ্টি হয় এবং বাজেট প্রণয়নে বিশেষ সমস্যার সৃষ্টি করে। আরও বোঝানো হয়েছে, টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেডের পরিবর্তে বার্ষিক ৩ থেকে ৫ শতাংশ চক্রবৃদ্ধি হারে বেতন বৃদ্ধি করলে চাকরিজীবীরা অধিক লাভবান হবেন। কিন্তু, তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেল এ তথ্য সঠিক নয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ভুল বোঝানো হয়েছে। বর্তমান ও সাবেক আমলারা (যেমন, পে-কমিশনের চেয়ারম্যান ও অর্থমন্ত্রী সাবেক আমলা) তথ্য গোপন রেখে তাদের গোষ্ঠীগত স্বার্থে এই কাজটি করেছেন।টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড প্রদানের ক্ষেত্রে পদোন্নতির প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়। ফলে পদোন্নতিজনিত কারণে যদি বেতন-ভাতার হিসাব আর বাজেট প্রণয়নে সমস্যা না হয় তাহলে টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড প্রদানের ক্ষেত্রেও কোন সমস্যা হওয়ার কথা নয়। আর টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বিষয়টি শুধু আর্থিক বিষয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়; বিষয়টি মর্যাদার সঙ্গেও জড়িত। কারণ, বর্তমান পে-স্কেল সরকারি চাকরজীবীদের মর্যাদা নির্ধারণে শ্রেণী প্রথার পরিবর্তে তাদের গ্রেডকে বিবেচনায় ধরার প্রস্তাব করা হয়েছে।টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড কী তা আগে জানা দরকার। পদোন্নতির সব শর্ত পূরণ করা সত্ত্বেও যখন একজন কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে শুধু শূণ্যপদের অভাবে বা ওপরে আর পদ না-থাকাতে পদোন্নতি দেয়া সম্ভব হয় না তখন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বা কর্মচারীর আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে দেয়ার জন্য তাকে ১টি বা ২টি গ্রেড উপরের স্কেলে বেতন-ভাতার সুবিধা দেয়া হয়। যেমন, বিসিএস সাধারণ শিক্ষাসহ ২৬ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সব শর্ত পূরণ সাপেক্ষে ৫ বছরে প্রথম পদোন্নতির কথা থাকলেও প্রথম পদোন্নতি পেতে ১০-১২ বছর লেগে যায়। ফলে চাকরির ৪ বছর পূর্তিতে কিছু শর্ত পূরণ সাপেক্ষে সিলেকশন গ্রেডের মাধ্যমে একজন কর্মকর্তাকে ৯ম গ্রেড থেকে ৭ম গ্রেডে বেতন-ভাতা প্রদান করা হয়।এখন দেখা যাক টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড পদ্ধতি বিলুপ্ত করার ফলে কারা কিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা অধ্যাপক পদে পদোন্নতির পর জাতীয় বেতন-স্কেলের ৩য় গ্রেডে বেতন-ভাতা পেয়ে থাকেন। এরপর একটি টাইম স্কেল পেয়ে তারা ২য় গ্রেডে উন্নীত হন। তারপর সিলেকশন গ্রেড পেয়ে তারা ১ নম্বর গ্রেডে উন্নীত হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকদের ২৫% এই সিলেকশন গ্রেড পেয়ে থাকেন। ৭ম পে-স্কেল সচিব ও সচিব পদ-মর্যাদার কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেকশন গ্রেড-প্রাপ্ত অধ্যাপকগণ ১ নম্বর গ্রেড ভোগ করতেন। কিন্তু ৮ম পে-স্কেল টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বিলুপ্ত করার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকগণ আর কখনো ৩য় গ্রেড অতিক্রম করতে পারবেন না। অন্যদিকে ৮ম পে-স্কেল মন্ত্রিপরিষদ সচিব, মুখ্য সচিব, জ্যেষ্ঠ সচিব ও সমমর্যাদার কর্মকর্তাদের জন্য ১ নম্বর গ্রেডেরও ওপরে আরও ২টি সুপার গ্রেড সৃষ্টি করার ফলে প্রকৃত বিচারে বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকগণ মন্ত্রিপরিষদ সচিবের থেকে ৪ ধাপ, জ্যেষ্ঠ সচিবের থেকে ৩ ধাপ আর সচিবের থেকে ২ ধাপ নিচে অবনমিত হয়ে যুগ্ম সচিবের স্তরে নেমে আসবেন।টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বিলুপ্ত করার ফলে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রকৌশল, কৃষিসহ ২৬টি ক্যাডারের কর্মকর্তাবৃন্দ ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বলে জানা গেছে। ২৬ ক্যাডারসহ অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের টাইমস্কেল ও সিলেকশন গ্রেডের মাধ্যমে গ্রেড উন্নয়ন ঘটে। ফলে আর্থিক ক্ষতি বাদ দিলেও গ্রেড উন্নয়ন বন্ধ করাতে তাদের মর্যাদা অবনমিত হবে। এই ২৬ ক্যাডারের কর্মকর্তাগণের সর্বোচ্চ ৪র্থ গ্রেড পর্যন্ত যাওয়ার সুযোগ থাকলেও অধিকাংশ কর্মকর্তাগণ ৪র্থ গ্রেডে পেঁৗছানোর আগেই অবসরে চলে যান। এই সরকারি মাধ্যমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পদগুলো প্রায় বস্নক পোস্ট। সেখানে ২ থেকে ৪ শতাংশ শিক্ষক সহকারী শিক্ষক থেকে প্রধান শিক্ষকের পদে পদোন্নতি পেয়ে থাকেন। বাকি ৯৮ থেকে ৯৬ শতাংশ শিক্ষক সারা জীবন পদোন্নতিবিহীন একই পদে চাকরি করেন। এই কারণে তাদের জন্য দুই-একটি টাইমস্কেল ও সিলেকশন গ্রেড অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বাতিল হলে জাতি গঠনের কারিগর এই শিক্ষকেরা সারা জীবন একই গ্রেডে থেকে যাবেন। শিক্ষক ছাড়াও অন্যান্য অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ক্ষেত্রে একই ঘটনা ঘটবে।টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বাতিলের গূঢ় রহস্যটি হলো, গত বছর ৩০টি দফতর বা প্রতিষ্ঠান প্রধানের পদ ১ নম্বর আর ২০টি প্রতিষ্ঠান প্রধানের পদকে ২ নম্বর গ্রেডে উন্নীত করা হয়েছে। এই পদগুলোতে স্ব-স্ব ক্যাডারের কর্মকর্তারা নিয়োজিত থাকলেও সুকৌশলে তাদের এখনও নিয়মিত পদায়নের লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এই পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষমতা প্রশাসন ক্যাডারকেন্দ্রিক মন্ত্রণালয়ের হাতে। এখন টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বাতিলের ফলে ২৬ ক্যাডারের কর্মকর্তাগণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে ৪র্থ গ্রেড আর ক্ষেত্রে বিশেষে ৩য় গ্রেড আর অতিক্রম করতে পারবেন না। তখন এসব ক্যাডারের কর্মকর্তাগণকে ১ নম্বর ও ২ নম্বর গ্রেডের অযোগ্য ঘোষণা করে সেখানে প্রশাসন ক্যাডারের আমলাদেরকে বসানো হবে।বর্তমানে পদের দ্বিগুণ বা তারও বেশি আমলাকে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। এইসব আমলা পদের অভাবে পূর্বপদে বা নিম্নপদে চাকরি করছেন। পদের অতিরিক্ত পদোন্নতি-প্রাপ্ত এসব আমলাদের ২৬ ক্যাডারের জন্য নির্ধারিত এ ৫০টি ১ ও ২ নম্বর গ্রেডের পদে বসানো হবে। আমলাদের অন্য ক্যাডারের পদ দখলের প্রচেষ্টাটি বেশ পুরাতন। যেমন, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক ও পরিচালকের পদগুলো সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের জন্য সিডিউলভুক্ত পদ হলেও বিগত এক দশকের বেশি সময় ধরে সেখানে আমলারা বসে আছেন।সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল বাতিলের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও অন্যান্য নন-ক্যাডার শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী মূল টার্গেট নন। মূল টার্গেট হলো ২৬ ক্যাডারের এ ৫০টি ১ ও ২ নম্বর গ্রেডের পদ। এ কারণে সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের দাবি মেনে নেয়ার সবুজ সংকেত দিলেও ২৬ ক্যাডারের দাবির বিষয়ে আমলারা অনড় অবস্থানে রয়েছেন।প্রশাসন ক্যাডারের সহকারী কমিশনার, সিনিয়র সহকারী কমিশনার এবং উপসচিবগণও অন্যান্য ক্যাডারের ন্যায় যথাক্রমে ৪ বছর, ১০ বছর এবং ১৮ বছর পূর্তিতে সিলেকশন গ্রেড পেয়ে আর্থিক ও মর্যাদার দিক দিয়ে লাভবান হয়ে থাকেন। ফলে প্রশাসন ক্যাডারের এই তিন স্তরের কর্মকর্তাদের মাঝে টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বাতিল করা নিয়ে মৃদু অসন্তোষ আছে। তাদের অসন্তোষ প্রবল নয় কারণ তারা নির্ধারিত সময়ে ব্যাচভিত্তিক পদোন্নতি পেয়ে থাকেন এবং তারা ১ নম্বর গ্রেড ছাড়িয়ে আরও ২টি সুপার গ্রেড পর্যন্ত পেঁৗছাতে পারেন যেখানে ২৬ ক্যাডার কর্মকর্তাদের পদ ৩য় বা ৪র্থ গ্রেডে থামিয়ে রাখা হয়েছে। ফলে টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বাতিলজনিত ক্ষতি প্রশাসন ক্যাডারের ওই তিন স্তরের কর্মকর্তাদের জন্য সাময়িক আর ২৬ ক্যাডারসহ অন্যদের জন্য স্থায়ী।এই পে-স্কেলটি প্রস্তত, বিচার-বিশ্লেষণ, কাটছাঁট আর বাস্তবায়ন পর্যায়ে যারা নিযুক্ত ছিলেন তারা সবাই প্রশাসন ক্যাডারের সাবেক ও বর্তমান আমলা। তারা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে তথ্য গোপন করে প্রশাসন ক্যাডার তথা আমলাদের স্বার্থরক্ষার চেষ্টা করেছেন, অন্যদের অবনমিত রেখে গোষ্ঠীগত শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন।চলতি মাসের ১৬ তারিখে ৮ম জাতীয় বেতন স্কেলে বেতন বৈষম্য দূর করা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি পুনর্গঠন করেছে সরকার। এ কমিটিতে অর্থমন্ত্রীকে আহ্বায়ক করে শিল্পমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী/প্রতিমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়কমন্ত্রী এবং অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীকে সদস্য করা হয়েছে।উপর্যুক্ত মন্ত্রী মহোদয়দের আন্তরিকতা নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই। কিন্তু, যেহেতু তারা বেতনভোগী চাকরিজীবী নন, সেহেতু নানা ক্যাডার ও নন-ক্যাডার চাকরিজীবীদের বৈষম্যগুলো তাদের জানার কথা নয়। এই কারণে তথ্য দিয়ে সাহায্য করার জন্য ওই কমিটির সহায়ক কর্মকর্তাদের মধ্যে ২৬ ক্যাডার প্রতিনিধি থাকা অত্যাবশ্যক ছিল। ২৬ ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশন অভিযোগ করেছে, সরকারকে অন্ধকারে রেখে, বিভ্রান্ত করে যে আমলারা এ পরিকল্পিত বৈষম্য সৃষ্টি করেছে, তাদেরই আবার এ বৈষম্য নিরসন কমিটির সহায়ক কর্মকর্তা নির্ধারণ করা হয়েছে। ফলে মন্ত্রীরা কোন তথ্য চাইলে এ আমলারা আগের মতোই তাদের গোষ্ঠীস্বার্থের অনুকূলে তথ্য সরবরাহ করবেন আর অন্যদের স্বার্থের বিষয়টি চেপে যাবেন। এ কমিটিকে সহায়তা করবেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব/সচিব, অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/বিভাগের সিনিয়র সচিব/সচিব ভারপ্রাপ্ত সচিবেরা। উল্লেখ্য, উপসচিব থেকে সচিব পর্যন্ত পদগুলোকে সুকৌশলে বাংলাদেশ সরকারের পদ বলা হলেও এইসব পদের ৯৯ শতাংশ বা তার বেশি কর্মকর্তা প্রশাসন ক্যাডারের। 'বাংলাদেশ সরকারের পদ' একটি বাহ্যিক মোড়ক মাত্র।টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বাতিল করলে ২৬ ক্যাডারের কর্মকর্তাসহ লাখ লাখ নন-ক্যাডার শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন আর মর্যাদার দিক থেকে হবেন অবনমিত। কতিপয় আমলাকে খুশি করতে এই ব্যাপক সংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রবল অসন্তোষের বোঝা সরকার কেন বহন করবে?
rahmanmm40@gmail.com

Published in: http://www.thedailysangbad.com/sub-editorial/2015/09/29/28062

Monday, September 28, 2015

মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা - প্রশ্ন ফাঁস, না স্বপ্নের ফাঁসি?

মো. জাকির হোসেন

প্রশ্ন ফাঁসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছে ছাত্রছাত্রীরা
নিজেদের মেধা ও শ্রম দিয়ে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ভর্তি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেয় অসংখ্য তরুণ-তরুণী। কিন্তু সমাজে ভদ্রতার মুখোশধারী কিছু দুর্বৃত্ত তাদের সে স্বপ্নকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে দিল। পরীক্ষার আগের দিনই চাউর হয়ে যায় ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের কাহিনি। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন। ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের কাহিনি পরীক্ষার আগের দিনই বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারিত হয়। এত কিছুর পরও নির্বিকার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
তবে নড়েচড়ে বসে সরকারের আরেক সংস্থা—র্যাব। প্রশ্ন ফাঁসে র্যাবের হাতে আটক হন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের এক সহকারী পরিচালকসহ তিনজন। র্যাব তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করে এবং আদালতের মাধ্যমে রিমান্ডে নেয়। এদিকে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর বিতর্কিত ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে তড়িঘড়ি ফলাফল প্রকাশ করে প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের নিরপরাধ বলে লাইসেন্স দিয়ে দেয়। সরকার বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করলেও প্রশ্ন ফাঁসের হোতাদের ধরতে র্যাবের অভিযান থেমে থাকেনি।
মেডিকেল কলেজে ভর্তির প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে রংপুরে তিন চিকিৎসকসহ সাতজনকে আটক করে র্যাব। আটককৃত তিন চিকিৎসক সরকারি চাকুরে এবং পদস্থ কর্মকর্তা। তিন চিকিৎসক হলেন রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অর্থোপেডিক বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার জিল্লুর হোসেন, সার্জারি বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার শরিফুল ইসলাম ও সদর উপজেলার স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান। অন্য চারজন হলেন রংপুরের প্রাইমেট কোচিং সেন্টারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মঞ্জুরুল রহমান, এ ওয়ান কোচিং সেন্টারের কর্মকর্তা জামিল উদ্দিন ও আতিকুর রহমান এবং সাজরাতুল ইয়াদিন রানা।
প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় সরকারের সন্দেহজনক ও পরস্পরবিরোধী আচরণ বেশ কিছু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এক. প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ ওঠার পর র্যাব কয়েকজনকে আটক করল। এরপরও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কোনো যাচাই-বাছাই না করে কেন কোন যুক্তিতে তড়িঘড়ি করে ফলাফল প্রকাশ করল?
দুই. ঘটনার তিন দিন পর কোনো তদন্ত বা অনুসন্ধান ছাড়াই কিসের ভিত্তিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মিনমিনে গলায় বিবৃতি প্রকাশ করল যে মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় অনিয়ম ও প্রশ্ন ফাঁস হয়নি, সুষ্ঠুভাবে পরীক্ষা হয়েছে। বিবৃতিতে দাবি করা হয়, প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ উত্থাপন ও ভর্তি পরীক্ষা বাতিল চেয়ে দাখিলকৃত রিট আবেদনটি হাইকোর্ট কর্তৃক খারিজের মাধ্যমে বিষয়টি ইতিমধ্যে মীমাংসিত। বিবৃতিদাতারা বিবেকের দর্পণে নিজেকে দেখুন আর প্রশ্ন করুন, সবকিছুর সমাধান হয়ে থাকলে ঈদের দিনেও প্রতারিত ভর্তি-ইচ্ছুকেরা কেন নতুন করে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার দাবিতে শহীদ মিনারে জমায়েত হলো। এই কোমলমতি তরুণ-তরুণীরা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ও সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী জামায়াত-বিএনপির সমর্থক বলে পার পাওয়ার জো নেই।
তিন. প্রশ্ন ফাঁস না হয়ে থাকলে র্যাব কিসের ভিত্তিতে ১০ জন মানুষকে এ অভিযোগে আটক করল? তাদের বিরুদ্ধে মামলা করল? রিমান্ডে নিল?
চার. প্রশ্ন ফাঁস না হয়ে থাকলে এ মর্মে সরকারের বিবৃতির পরও র্যাব রংপুর থেকে কেন সাতজনকে আটক করে কারাগারে পাঠাল? অভিযোগের কোনো ভিত্তি না থাকলে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দুজন সহকারী রেজিস্ট্রার ও সদর উপজেলার স্বাস্থ্য কর্মকর্তার মতো সমাজের সম্মানীয় ব্যক্তিদের কেন আটক করা হলো? কেবল সন্দেহের ভিত্তিতে সমাজের এমন সম্মানীয় ব্যক্তিদের র্যাব আটক করেছে, তা কি আদৌ গ্রহণযোগ্য?
পাঁচ. প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগের কোনো ভিত্তি না থাকলে আদালত কিসের ভিত্তিতে আটককৃতদের রিমান্ড মঞ্জুর করলেন?
ছয়. প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে পুনরায় পরীক্ষা নেওয়ার দাবিতে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলনরত মেডিকেলে ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের পুলিশ কেন লাঠিপেটা করল? এটা তো কোনো রাজনৈতিক দলের আন্দোলন ছিল না।
সাত. বিগত বছরগুলোয় যেখানে শিক্ষার্থীরা ৫০-এর কিছু অধিক নম্বর পেয়েই সরকারি মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে, সেখানে কীভাবে এবার ভর্তির সর্বনিম্ন নম্বর ৭৭ দশমিক ৪০ হলো? আলাদিনের কোন চেরাগের স্পর্শে এটা সম্ভব হলো যে ৮০-৯০-এর ঘরে নম্বর পেয়েছে দুই হাজারেরও অধিক পরীক্ষার্থী? এটা কী করে সম্ভব হলো যে যারা কলেজের টেস্ট পরীক্ষায় প্রথমবার উত্তীর্ণ হতে পারেনি, বিশেষ বিবেচনায় দ্বিতীয়বার টেস্ট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও এবারের মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষায় মেধাতালিকায় স্থান পেল? কোন গায়েবি মদদে তারা মেডিকেলে পড়ার সুযোগ পেয়ে গেল?
আট. প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়ে কোনো প্রকার যাচাই-বাছাই না করেই সরকার যে সবকিছু তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিচ্ছে, ভবিষ্যতে যদি ফাঁসের সত্যতা প্রকাশ হয়ে পড়ে, তখন কী হবে?
নয়. সরকার প্রশ্ন ফাঁসের বিষয় আমলে না নিলে র্যাব যাদের আটক করেছে, তাদের অপরাধের শাস্তি দেওয়া সম্ভব হবে না। কারণ, তাদের পক্ষ থেকে তাদের আইনজীবীরা সাধারণ একটি যুক্তি তুলে ধরবেন, প্রশ্ন যদি ফাঁস হতো, তাহলে সরকার ভর্তি পরীক্ষা বাতিল করত। নিদেনপক্ষে তদন্ত কমিটি গঠন করত। যেহেতু সরকার এসব কিছুই করেনি, তার মানে প্রশ্ন ফাঁস হয়নি। তাই আমার মক্কেল নিরপরাধ। এ যুক্তিতেই অপরাধীরা ছাড়া পেয়ে যাবে।
দশ. সরকার কিসের ভিত্তিতে জোরগলায় বলছে যে প্রশ্ন ফাঁস হয়নি? কাউকে যদি প্রশ্ন করা হয়, এ সরকারের বড় ব্যর্থতা কী? উত্তরের জন্য রকেটবিদ্যার দরকার নেই। চোখ বন্ধ করে তিনি বলে দিতে পারবেন প্রশ্ন ফাঁস প্রতিরোধ করতে না পারা এবং ফাঁস প্রশ্ন জায়েজ করতে তার পক্ষে নানা সাফাই গাওয়া।
কোন প্রশ্ন ফাঁস হয়নি? বোর্ড পরীক্ষা থেকে শুরু করে, চাকরির পরীক্ষা, ভর্তি পরীক্ষা। এমনকি শিক্ষা সমাপনী ও জেএসসি পরীক্ষার প্রশ্নও ফাঁস হওয়ার খবর বেরিয়েছে পত্রপত্রিকায়। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, কোন প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে, সেটা আলোচনার বিষয় নয়, বরং কোনটা ফাঁস হয়নি, তা-ই আলোচনার বিষয়। শিক্ষামন্ত্রী নিজেই তো সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছেন, প্রশ্ন ফাঁস ঠেকানো সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ।
তাই, সরকারকে বলি, গোঁ ধরে থাকবেন না। এখনো সময় আছে। তদন্ত করুন, সত্য উদ্ঘাটন করুন। দোষী ব্যক্তিদের শাস্তির পথ প্রশস্ত করুন। প্রয়োজনে আবারও ভর্তি পরীক্ষা নিন।


মো. জাকির হোসেন: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
zhossain@justice.com

Published in: http://www.prothom-alo.com/opinion/article/641503

শিক্ষকদের ন্যায্য দাবি মেনে নিন - প্রথম আলো সম্পাদকীয়


গতকাল সোমবার প্রথম আলোর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বেতনবৈষম্য নিরসনে গঠিত মন্ত্রিসভা কমিটির প্রতি আস্থা রাখার জন্য আন্দোলনরত শিক্ষকদের প্রতি যে আহ্বান জানিয়েছেন, তার সঙ্গে আশা করি সংশ্লিষ্ট শিক্ষকেরাও দ্বিমত করবেন না। তবে এ ক্ষেত্রে সরকারকেই অধিক দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে।

শিক্ষামন্ত্রী সমস্যা সমাধানে আলোচনার ওপর গুরুত্ব দিলেও সেটি কীভাবে এগোবে, আলোচনা শেষ হতে কত দিন লাগবে, সে বিষয়ে স্পষ্ট কিছু বলেননি। শিক্ষকনেতারা শুরু থেকেই আলোচনার তাগিদ দিয়ে আসছেন। বরং সরকারের পক্ষ থেকেই এ ব্যাপারে সাড়াটি এসেছে বেশ বিলম্বে। কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাই নন, আন্দোলনে আছেন বা আন্দোলনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন কলেজ, মাধ্যমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও। তাঁদের দাবি অযৌক্তিক, সে কথা বলা যাবে না। তাঁরা আগের বেতনকাঠামোর সুযোগ-সুবিধা বহাল রাখার কথা বলছেন। নতুন করে কোনো দাবি উত্থাপন করেননি।

শিক্ষক আন্দোলনের বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্বের সঙ্গে দেখা উচিত এ কারণে যে এর সঙ্গে লাখ লাখ শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন জড়িত। অক্টোবর থেকে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি-প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কথা। পাশাপাশি অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বার্ষিক পরীক্ষার বিষয়টিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিরোধী দলের হরতাল-অবরোধের কারণে বছরের প্রথম তিন মাস শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। বছরের শেষে এসে তার পুনরাবৃত্তি কাম্য নয়।
দুর্ভাগ্যজনক যে, বেতন কমিশন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দ্বিগুণ করলেও শিক্ষকদের প্রতি সদয় হতে পারেনি। প্রতিবেদন ঘোষণার আগে কমিশন শিক্ষকদের সঙ্গে বসলেও কেন তাঁদের ন্যায়সংগত দাবিদাওয়া আমলে নেওয়া হলো না, সেটিই বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সরকারের উচিত কমিশনের ভুলটি দ্রুত শুধরে নেওয়া। মন্ত্রিসভা কমিটির প্রধান অর্থমন্ত্রী এখন দেশের বাইরে। তিনি দেশে ফেরামাত্র শিক্ষকনেতাদের সঙ্গে আলোচনায় বসে সমস্যার সমাধান বের করা দরকার। এ ব্যাপারে সময়ক্ষেপণ বা আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতা শিক্ষাঙ্গনে ফের অস্থিরতা ডেকে আনতে পারে।


published in: http://www.prothom-alo.com/opinion/article/641464/

শিক্ষকদের বেতন বৈষম্য দূরীকরণ কমিটির অগ্রগতি কী

কুন্তলা চৌধুরী
‘কী আশায় বাঁধি খেলাঘর বেদনার এই বালুচরে।’ আশা, আস্থা, ভরসা, সম্মান, বিশ্বাস—এ ধরনের ইতিবাচক শব্দগুলো বালুচরে ঢেউয়ের ভিড়ে বারবারই হারিয়ে যাচ্ছে। তাই এ আস্থা ভাঙাগড়ার খেলায় আজ আর কোনোভাবেই আশার সঞ্চার হয় না। শিক্ষকসমাজের মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার জন্য সম্মানজনক বেতন কাঠামোর কথা সরকার প্রথম থেকেই বলছে, হচ্ছে, হবে। আর শিক্ষকরা বলে যাচ্ছেন, কবে? এখন বলতে হয়, আর কবে?

বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়েই ঈদুল আজহার ছুটি ৫ অক্টোবরের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে। বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পর আগামী ৬ অক্টোবর সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেডারেশনের বৈঠক ডাকা হয়েছে। ওই দিনই পরবর্তী কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ভর্তি মৌসুম চলছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এরই মধ্যে ভর্তি-ইচ্ছুকদের আবেদন গ্রহণ করা হয়েছে। আগামী ৯ অক্টোবর এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা শুরু হবে। ফেডারেশনের সূত্রে জানা গেছে, সবাই ভর্তি পরীক্ষা বন্ধের পক্ষেই মত দিয়েছেন। একই সঙ্গে লাগাতার কর্মবিরতি ডেকে সব বিশ্ববিদ্যালয় অচল করে দেওয়ার পক্ষে সবার অবস্থান।

শিক্ষাবান্ধব এ সরকার বেতন বৈষম্যকে দূর করার জন্য আগের কমিটিকে পুনর্গঠন করেছে। শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী এ কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। নিঃসন্দেহে এটা অত্যন্ত শক্তিশালী কমিটি। কিন্তু অর্থমন্ত্রী কমিটির প্রধান থাকায় শিক্ষকরা এ কমিটি প্রত্যাখ্যান করেছেন। যদিও তিনি শিক্ষকদের কটূক্তি করে দুঃখ প্রকাশ করেছেন; কিন্তু তাঁর ওপর আবারো আস্থা রাখা শিক্ষকসমাজের জন্য কঠিন।

গত ৭ সেপ্টেম্বর কমিটির ওপর দায়িত্ব দেওয়া হলো, অথচ এর মধ্যে এ কমিটিতে একটি সভাও অনুষ্ঠিত হয়নি। উপরন্তু কমিটি প্রধান শিক্ষকদের অপমান করে এক মাসের জন্য চলে গেছে দেশের বাইরে। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর ওপর শিক্ষকদের আস্থা থাকলেও এ রকম একটি গুরুত্বপূর্ণ কমিটির প্রধান যখন গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেন না, তখন আস্থা শব্দটি অনাস্থাতেই পরিণত হয়। 

আসলে অনেকেই চাইছেন না, যে শিক্ষকদের মর্যাদা অটুট থাকুক। কোনো এক স্বার্থান্বেষী মহল অপরকে বঞ্চিত করার মধ্য দিয়ে নিজেকে চিরস্থায়ীভাবে ক্ষমতার আসনে অধিষ্ঠিত করতে চাইছেন। এবং এটা করে বারবার তারা হীনমন্যতার পরিচয় দিচ্ছেন।

অনেক আগে থেকেই আমরা শুনে আসছি, শিক্ষানীতি বাস্তবায়িত হবে, যা শিক্ষকদের স্বতন্ত্র ও সম্মানজনক বেতন কাঠামোও নিশ্চিত করতে পারে। তবে এ নীতি বাস্তবায়িত হতে আইন পাস করা জরুরি। কিন্তু এ নীতি বাস্তবায়ন দূরের কথা, যতগুলো কমিটি করা হয়েছে কোনো কমিটি থেকেই পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট পেশ করা হয়নি। যদি শিক্ষা খাতে বরাদ্দের কথা বলি, তবে সেটাও অন্যান্য খাতের তুলনায় অনেক কম। আমাদের দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ই বিশ্ব র‍্যাংকিংয়ের পাঁচ হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেও নেই। এ ব্যাপারে কোনো ব্যক্তি বিশেষ দায়ী নয়। সমগ্র ব্যবস্থা দায়ী, যা নতুন করে ঢেলে সাজানো দরকার। সত্যিকার অর্থে বিনিয়োগ যদি ঠিকভাবে না হয়, তবে মুনাফার আশা করা বৃথা। আমাদের শিক্ষা খাতেরও একই অবস্থা। তার পরিণতি আজ শিক্ষার দুরবস্থা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সারির শিক্ষার্থী মানেই সে হবে আগামী দিনের উজ্জ্বল শিক্ষক। এ স্বপ্ন আর কেউই হয়তো দেখবে না। বা খুব ভালো ফল করে বিদেশ থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়ে হয়তো আজ আর কেউ দেশে ফিরে আসবে না মাটির টানে, দেশের টানে, শিক্ষার্থীর টানে। পাচার হয়ে যাবে সকল মেধাবী, মেধা। আর থেকে যাওয়া মেধাবীরা হয়তো শিক্ষার্থীর পড়াশোনার চেয়ে বেশি নজর দেবে বিদেশি এনজিও বা ডোনার এজেন্সির প্রকল্পে। 

তাই বোধকরি বেতন কাঠামো ঠিক করার এখনই সময়, আর দেরি নয়; হচ্ছে-হবে, কবে-কবে করে আর আশায় বুক বাঁধতে চান না শিক্ষকরা। হলে সেটা এখনই হতে হবে। না হলে তরুণ শিক্ষকরা হয়তো হতাশ হয়ে পড়বেন এবং তাদের পেশা পরিবর্তন করবেন, নয়তো বিদেশে পাড়ি জমাবেন।
লেখক : প্রভাষক, উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।

Published in: http://www.ntvbd.com/opinion/22550

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পদমর্যাদা প্রসঙ্গে

তারেক শামসুর রেহমান

দেশের ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আন্দোলন করছেন মূলত দুটি বিষয় সামনে রেখে। এক. তাদের জন্য স্বতন্ত্র একটি পে-স্কেল গঠন এবং দুই. তাদের পদমর্যাদা পুনর্নির্ধারণ। এ ব্যাপারে ১৯ সেপ্টেম্বর শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে তাদের বৈঠক হলেও তা ফলপ্রসূ হয়নি। একজন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে আমি যেমন আমার সহকর্মীদের দাবি-দাওয়ার বিরুদ্ধে যেতে পারি না, ঠিক তেমনি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ব্যাপারে যে নেতিবাচক ধারণার জন্ম হয়েছে, আমি তা অস্বীকার করি কীভাবে? পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন বাড়ানো হোক, কিংবা আলাদা পে-স্কেল দেয়া হোক, এটা বোধকরি সবাই সমর্থন করবেন। তবে তাদের একটা দায়বদ্ধতা সৃষ্টি করাও জরুরি।

কিছুদিন আগে একটি বেসরকারি টিভির টক-শো দেখছিলাম। আলোচক ছিলেন শিক্ষা সচিব এনআই খান এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য অধ্যাপক মহব্বত খান। নজরুল সাহেব ‘স্পষ্টভাষী’ মানুষ, ‘ভালো কিছু’ করতে গিয়ে এর আগে তিনি বিতর্কিত হয়েছিলেন। কিন্তু ওই দিন টিভিতে তিনি যা বলেছিলেন, তা অস্বীকার করি কীভাবে? পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এক একটি পারিবারিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে। শিক্ষকদের সন্তানরা মেধাবী হবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাকে বাবা অথবা মায়ের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হতে হবে কেন? যুক্তরাষ্ট্রে এমনটি নেই। একজন ছাত্র যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করেন, তিনি সাধারণত ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হন না। তারা তা পারেন না। কিন্তু আমরা তা করি। দিব্যি সিনিয়র শিক্ষক হয়ে আমার সন্তানকে রাজনৈতিক বিবেচনায় শিক্ষক বানিয়ে দিচ্ছি। আমরা সুযোগ দিচ্ছি না আমার সন্তানকে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়ে তার মেধার বিকাশ ঘটাতে। প্রতিটি পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এমনটি হচ্ছে। শিক্ষা সচিব এ কথাটাই বলেছিলেন ওই দিন। অধাপক মহব্বত খান গুণী শিক্ষক। আমার নিজেরও শিক্ষক। অত্যন্ত রাসভারী মানুষ। বলেছিলেন শিক্ষকদের পদোন্নতির তথাকথিত ‘রিস্ট্রাকচারিং’ নীতিমালা নিয়ে। তিনি নিজে এর ঘোর বিরোধী। অনেক কিছুই ইদানীংকালে বলা যায় না। পিএইচডি ছাড়া অধ্যাপক হওয়া পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে কি সম্ভব? আমরা পার্শ্ববর্তী দেশের কিংবা পাকিস্তানের দৃষ্টান্ত দিই পে-স্কেলের ব্যাপারে। কিন্তু সেসব দেশে কি পিএইচডি ছাড়া অধ্যাপক হওয়া যায়? শুধু বলে রাখি, পাকিস্তানের মতো দেশেও পাস করেই প্রভাষক হওয়া যায় না। যার নিজেরই পিএইচডি ডিগ্রি নেই, তিনি এ দেশে অবলীলায় পিএইচডির তত্ত্বাবধান করছেন! পিএইচডি ছাড়া শুধু অধ্যাপকই নয়, এমনকি মঞ্জুরি কমিশনের মতো জায়গায়ও নিয়োগ পাচ্ছি আমরা! বিজ্ঞানের কোনো ডিগ্রি না থাকলেও শুধু ‘রাজনৈতিক বিবেচনায়’ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে! এ বিষয়গুলো নিয়ে আমরা কেউ ভাবি না। প্রতিটি বিষয়ের জন্য যদি আমাদের প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়, তাহলে এর চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক কিছু হতে পারে না।

অর্থমন্ত্রী শিক্ষকদের নিয়ে কিছু কড়া মন্তব্য করেছিলেন। পরে দুঃখও প্রকাশ করেছেন। কিন্তু বাস্তবতা কী বলে? আমরা যারা শিক্ষক, আমাদেরও ভেবে দেখার বিষয় রয়েছে। ১৯৭৩ সালের পদোন্নতির নীতিমালার সঙ্গে ২০১৫ সালের পদোন্নতির নীতিমালাকে মেলানো কি ঠিক হবে? একটু চিন্তাভাবনা করা দরকার। তবে অভিযোগ যাই থাকুক না কেন, শিক্ষকদের সমাজে পদমর্যাদা দিতে হবে। শিক্ষকরা যদি মর্যাদা না পান, তাদের মাঝে ক্ষোভ থাকবেই।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নতুন পে-স্কেলে খুশি হননি। তাদের যুক্তি, সিনিয়র শিক্ষকরা এখন ‘সিলেকশন গ্রেড’ বাতিল হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তারা সচিব পদমর্যাদার গ্রেড-১-এর সুযোগ-সুবিধা, বেতনও পাবেন না। প্রশ্ন উঠতেই পারে, সচিবরা নিজেদের সুবিধার জন্য যদি সিনিয়র সচিবের পদ সৃষ্টি করতে পারেন, তাহলে শিক্ষকদের জন্য সিনিয়র অধ্যাপকের পদ নয় কেন? বেতন স্কেলে অধ্যাপকের (সিনিয়র অধ্যাপক নন) গ্রেড এখন ৩-এ। অর্থাৎ তার বেতন শুরু হবে ৫৬,৫০০ টাকা দিয়ে। রাষ্ট্রের ‘ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে’ তাদের অবস্থান অনেক নিচে, যুগ্ম সচিবেরও নিচে! এটা কি শোভন? একজন অধ্যাপককে কি যুগ্ম সচিবের সঙ্গে তুলনা করা যায়? তাহলে একজন উপাচার্যের পদমর্যাদা কী? তিনি যদি ‘সিলেকশন গ্রেড’ভুক্ত প্রফেসর না হয়ে থাকেন (৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দু-একজন বাদে কেউই সিলেকশন গ্রেডভুক্ত প্রফেসর নন), তাহলে তার পদমর্যাদা কী হবে? ঢাকা বা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা কি সরকারি কোনো অনুষ্ঠানে তার ‘ছাত্রতুল্য’ যুগ্ম সচিবদের কাতারে একসঙ্গে বসবেন? সচিব মহোদয়রাই এ কাজটি করলেন! তারা নিজেদেরকে শিক্ষকদের চেয়েও উপরে রাখলেন। অথচ অভিযোগ আছে অনেক সচিবের ডিগ্রি নাকি ‘ভুয়া’। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পাস করেছেন, এমন সংখ্যাও কম নয়। এমনকি অনেকে ‘ভুয়া পিএইচডি’ ডিগ্রিও ব্যবহার করেন! ইদানীং দেখি অনেক সিনিয়র সচিব তাদের নামের আগে ‘ডক্টরেট’ ডিগ্রি ব্যবহার করেন। কীভাবে পেলেন এই ডিগ্রি? কোথায় করলেন? এখন তারাই যদি নিজেদের সিনিয়র অধ্যাপকের উপরে রাখেন, তা দুঃখজনক।

শিক্ষক আর সচিব কখনও এক হতে পারে না। তাদের কাজের ধরন আলাদা আলাদা। একজন সচিব যে শুধু এখন বেশি বেতন পাবেন, তাই নয়। তাদের সুযোগ-সুবিধা কয়েক লাখ টাকার সমান। যেমন একজন সচিব সার্বক্ষণিক তিনটি গাড়ি ব্যবহার করেন। তার স্ত্রী রাষ্ট্রের কর্মচারী নন। রাষ্ট্রীয় কাজে তিনি কোনো অবদানও রাখেন না। অথচ তিনি সার্বক্ষণিক একটি গাড়ি ব্যবহার করেন! বিভিন্ন প্রকল্প থেকে গাড়ি নিয়ে তা ব্যবহার করেন তার সন্তানরা! যে ‘বাংলো বাড়ি’তে তিনি থাকেন, তার বাসাভাড়া হিসাব করলে মাসপ্রতি ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা। তাদের জন্য গ্যাস, বিদ্যুৎ বিল খুব সম্ভবত ‘ফ্রি’। গাড়ির অকটেন, গ্যাস ফ্রি। হিসাব করুন, এ রাষ্ট্র একজন সচিবের জন্য কী খরচ করে, সে তুলনায় একজন শিক্ষক কী পান। এই বেতনই তার একমাত্র ভরসা। আমি কয়েক ডজন অধ্যাপককে চিনি, যাদের গাড়ি নেই, বাড়ি নেই, চলেন রিকশায় আর লক্কড়মার্কা বাসে। রাষ্ট্র তাদের জন্য ট্যাক্স ফ্রি গাড়ি কেনার ব্যবস্থা করে দেয়নি। কিংবা সরকারি ব্যাংক থেকে কম সুদে বাড়ি, ফ্ল্যাট বা গাড়ি ক্রয় করার ব্যবস্থা করে দেয়নি। অথচ তারাই তথাকথিত ‘সমাজ গড়ার কারিগর’! তারাই সচিবদের ‘জন্ম’ দিয়েছেন, তৈরি করেছেন, শিক্ষিত করেছেন। আর এ সচিব কমিটিই তাদের অমর্যাদা করল। অর্থমন্ত্রী যে ভাষায় শিক্ষকদের সমালোচনা করেছেন, তা ছিল অনাকাক্সিক্ষত। একজন অবিবেচক মানুষ তিনি। তিনি যে মনেপ্রাণে একজন ‘আমলা’, সেটাই তিনি প্রমাণ করলেন! পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জ্ঞানের গভীরতা নিয়ে তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন। তার মতো একজন সিনিয়র সিটিজেনের কাছ থেকে আমরা এটা আশা করিনি। তার অনাকাক্সিক্ষত বক্তব্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে সরকারকে একটা মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। তিনি অবশ্য তার বক্তব্য প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। কিন্তু ‘ক্ষতি’ যা হওয়ার তা হয়ে গেছে।

এটা সত্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সবকিছুর ঊর্ধ্বে নন। এটা আমি মনেও করি না। যাদের শিক্ষক হওয়ার কথা ছিল না, তারা ‘রাজনৈতিক বিবেচনায়’ শিক্ষক হয়েছেন- এটা অস্বীকার করা যাবে না। যিনি যে বিভাগের ‘ছাত্র’ নন, তাকে সেই বিভাগে ‘বিশেষ বিবেচনায়’ শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। পদোন্নতির নীতি প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এক, তা বলা যাবে না। এ ব্যাপারে অনেক সরকারি আমলার মাঝে আমি এক ধরনের ‘ক্ষোভ’ দেখেছি। আমার ছাত্র, যারা আমলা হয়েছে, তাদেরও দেখেছি এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে।

শিক্ষকরা তাদের যোগ্যতা বলেই পদোন্নতি পেতে চান। কিন্তু এ নীতিমালা যেন সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে এক হয়, এটাও নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এমনও দেখা গেছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদোন্নতির নীতিমালার সঙ্গে বেশ পার্থক্য রয়েছে ঢাকা বা জাহাঙ্গীরনগরের নীতিমালার। সরাসরি প্রভাষক হিসেবে নিয়োগেরও আমি বিরোধী। যিনি ভালো ছাত্র, তিনি ন্যূনতম এক বছর গবেষণা করবেন, সিনিয়র শিক্ষকের সহযোগী হিসেবে কাজ করবেন, অভিজ্ঞতা অর্জন করবেন, তারপরই তাকে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হোক। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে, কোনো কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দু-একজন শিক্ষক কোনো কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ‘ফুলটাইম’ চাকরি করেন। নৈতিকভাবে তারা কি এটা পারেন? উপাচার্য মহোদয়রা এসব জানেন। কেননা তাদের অনুমতি নিয়েই এ ধরনের কাজ হয়। এ প্রবণতা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। অর্থনীতি কিংবা ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের শিক্ষকরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ক্লাস নেয়ার’ নাম করে ফুলটাইম চাকরিও করেন। নাট্যকলার শিক্ষকরা কাজ করছেন মিডিয়ায়, চ্যানেলে। এটা দুঃখজনক। এটা বন্ধ হোক।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসরদের বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দেয়া হোক। তাদের বিনা সুদে গাড়ি, ফ্ল্যাট কেনার ব্যবস্থা করা হোক। মূল বেতনের সঙ্গে অতিরিক্ত আরও ১০ হাজার টাকা দেয়া হোক ‘বিশেষ ভাতা’ হিসেবে, যাতে তারা নিরুৎসাহিত হন অন্যত্র ক্লাস নিতে। সব বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি আইনের আওতায় আনা হোক। সব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একই পদোন্নতির নীতিমালা হোক। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে পিএসসির মতো আলাদা একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করা হোক। তরুণ শিক্ষকদের পিএইচডি করতে ‘ফান্ডে’র ব্যবস্থা করা হোক এবং পিএইচডি ছাড়া অধ্যাপক পদে পদোন্নতি নিষিদ্ধ হোক। অধ্যাপক পদে দুটি গ্রেড করা হোক- গ্রেড-১ ও গ্রেড-২। ‘সিলেকশন গ্রেড’ অথবা ১০ বছর অধ্যাপক পদে থাকা অধ্যাপকদের গ্রেড-১-এ পদোন্নতির ব্যবস্থা করা হোক। তবে শর্ত থাকবে, তাকে একটি গবেষণামূলক বই লিখতে হবে। এছাড়া শিক্ষকদের গবেষণামূলক পাঠ্যবই লিখতে উৎসাহিত করা হোক। এটা আছে বটে; কিন্তু কেউই তা ব্যবহার করেন না।

মোটকথা, শিক্ষকদের জন্য একটা দায়বদ্ধতা সৃষ্টি করা হোক। এ দায়বদ্ধতার জন্য চাই সুস্পষ্ট একটি নীতিমালা। একজন শিক্ষক কী করবেন, কতটুকু করতে পারবেন, এ বিষয়ে সুস্পষ্ট নীতি থাকা প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা স্বায়ত্তশাসনের ভিন্ন ব্যাখ্যা করছেন কি-না, এটা ভেবে দেখা দরকার। রাষ্ট্র বেতন-ভাতা দেবে; কিন্তু এর যেন অপব্যবহার না হয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা পুরোটাই সরকারি টাকায় চলেন। এ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের ‘আন্দোলনের’ সীমারেখা কতটুকু থাকা উচিত, তারা কতদূর পর্যন্ত যেতে পারবেন- এর একটা সুস্পষ্ট নীতি থাকা উচিত। ১৯৭৩ সালের পরিস্থিতির সঙ্গে ২০১৫ সালের পরিস্থিতি মেলানো ঠিক হবে না। বেতনবৈষম্যকে কেন্দ্র করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মাঝে এখনও ক্ষোভ বিরাজ করছে। সরকার বেতনবৈষম্য দূর করার জন্য আগের কমিটিকে পুনর্গঠন করেছে। শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী এ কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। এটা অত্যন্ত পাওয়ারফুল কমিটি। কিন্তু অর্থমন্ত্রী এ কমিটির প্রধান থাকায় শিক্ষকরা তা প্রত্যাখ্যান করেছেন।

আগামী অক্টোবরের মাঝামাঝি ছাড়া এ কমিটির বৈঠকের কোনো সম্ভাবনা নেই। ফলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা সংকট থেকেই গেল। আরও একটা কথা। শিক্ষকরা যদি বেতনবৈষম্য আর পদমর্যাদা নিয়ে পড়ে থাকেন, এটাও ঠিক হবে না। বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো একটি ৫ হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে নেই। অর্থাৎ শিক্ষকতার মান কমে গেছে। যোগ্য শিক্ষক তৈরি হচ্ছে না। যোগ্য শিক্ষক তৈরি করার দায়িত্বটি নিতে হবে মঞ্জুরি কমিশনকে। তরুণ শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ জরুরি। আমরা আমাদের মর্যাদা ফিরে পেতে চাই- এটা যেমন সত্য, ঠিক তেমনি আমাদের দায়িত্ব বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে আমাদের অবস্থান বাড়ানো।

ড. তারেক শামসুর রেহমান : প্রফেসর, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

tsrahmanbd@yahoo.com

Published in: http://www.jugantor.com/window/2015/09/28/329099

Sunday, September 27, 2015

শিক্ষকদের অসন্তুষ্টি কারও কাম্য নয়- শিক্ষামন্ত্রী

নুরুল ইসলাম নাহিদবেতনবৈষম্য ও মর্যাদার প্রশ্নে শিক্ষকদের আন্দোলনের কারণে শিক্ষাঙ্গনে চলছে একধরনের অস্থিরতা। এই অবস্থায় সরকারের করণীয় সম্পর্কে বলেছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিশেষ প্রতিনিধি শরিফুজ্জামান
প্রথম আলো: এখন বছরের শেষ ভাগ। এক-দেড় মাসের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সমাপনী পরীক্ষা ও জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা। এরপর বার্ষিক পরীক্ষা। শিক্ষক আন্দোলনে শিক্ষার ক্ষতির আশঙ্কা করছেন কি?
নুরুল ইসলাম: শিক্ষকেরা শিক্ষার নিয়ামক শক্তি। তাঁরা অসন্তুষ্ট থাকুক, এটা কারও কাম্য নয়। ক্লাস বা পরীক্ষা না হলে শিক্ষার ক্ষতি তো হবেই। সেই ক্ষতির যুক্তি বা প্রয়োজন আছে কি না, তা বিবেচনা করার অনুরোধ করব। তাঁদের দাবি কীভাবে পূরণ করা যায়, সরকার সেই পথ খোঁজার চেষ্টা করছে।
প্রথম আলো: সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা বলছেন, আন্দোলন ও আলোচনা একসঙ্গে চলবে। এ প্রসঙ্গে সরকারের মনোভাব কী? তাঁদের মধ্যে কি আস্থার অভাব রয়েছে বলে আপনার মনে হয়?
নুরুল ইসলাম: আন্দোলন, আবেগ ও উত্তেজনার আর প্রয়োজন নেই। তবে আলোচনার আরও প্রয়োজন আছে। সরকার শিক্ষকদের দাবিকে গুরুত্ব দিয়েই মন্ত্রিসভার যে বৈঠকে জাতীয় বেতন স্কেল অনুমোদন হয়েছে, সেই বৈঠকে বেতনবৈষম্য নিরসনসংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি গঠন করেছে। আর তাঁদের মধ্যে আস্থার অভাব আছে কি না, এটা তাঁরাই ভালো বলতে পারবেন। আমরা তাঁদের বলেছি যুক্তিসংগত প্রস্তাব দিতে। সেটি দিয়ে তাঁরা সরকারকে সহায়তা করবেন, না আন্দোলন করবেন—এটাও তাঁদের বিবেচ্য বিষয়।
প্রথম আলো: ২১ সেপ্টেম্বর মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে শিক্ষকদের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আপনার কথা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী কী বলেছেন?
নুরুল ইসলাম: শিক্ষকদের দাবিদাওয়ার বিষয়গুলো কীভাবে সমাধান করা যায় এবং কীভাবে এগোনো যায়, প্রধানমন্ত্রী সে বিষয়ে কথা বলেছেন। তা ছাড়া মন্ত্রিসভার বৈঠকেই বেতনবৈষম্য নিরসনসংক্রান্ত কমিটি গঠন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি নিয়ে আন্তরিক না হলে তো এই কমিটি হতো না।
প্রথম আলো: শিক্ষকেরা তাঁদের দাবি পূরণে বিলম্বের আশঙ্কা করছেন। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার অভিযোগও রয়েছে তাঁদের। কত দিনের মধ্যে এ সমস্যার সমাধান মিলতে পারে?
নুরুল ইসলাম: শিক্ষকেরা কেন এমন আশঙ্কা করছেন, সেটি তাঁরা বলতে পারবেন। তবে কিছুটা সময় তো দিতেই হবে। জাতীয় বেতন স্কেল অনুমোদন হওয়ার পর বেতন বুক তৈরির কাজ চলছে। এটা বিশাল কর্মযজ্ঞ। অর্থ মন্ত্রণালয় বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে। তবে এ কাজের জন্য আমরা বসে থাকছি না। ওই কাজও চলবে, অর্থমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন কমিটি বেতনবৈষম্য নিরসনের কাজটিও এগিয়ে নিয়ে যাবে।
প্রথম আলো: আপনি বলছেন, সরকার শিক্ষকদের দাবির প্রতি আন্তরিক। কিন্তু সেই আন্তরিকতার প্রকাশ ঘটাতে একটু বেশি সময় লাগছে কি না।
নুরুল ইসলাম: শিক্ষকদের দাবির প্রতি আন্তরিকতা না থাকলে তো আর নতুন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হতো না। বলা হতো, মন্ত্রিসভা যেটা অনুমোদন করেছে সেটাই চূড়ান্ত। তা কিন্তু বলা হয়নি। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, শিক্ষকেরা কিন্তু এখনো আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন না। সবার মতো তাঁদেরও বেতন বা অন্য সুযোগ-সুবিধা বেড়েছে। গ্রেড পরিবর্তন বন্ধ হওয়া বা মর্যাদা অবনমন হওয়ার কারণে তাঁরা আর্থিকভাবে এখনই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, এমনটি নয়। আর পৃথক বেতন স্কেল না হওয়া পর্যন্ত বিদ্যমান সব সুবিধাই তাঁরা পেতে থাকবেন। কিন্তু এসব বিষয় চট করে সমাধান করা যায় না। এ জন্য আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতেই হবে।
প্রথম আলো: বিসিএস (শিক্ষা) শিক্ষকেরা এরই মধ্যে কয়েক দিন ধর্মঘট করেছেন, আরও কঠোর কর্মসূচি নেওয়ার কথা বলেছেন। তাঁদের বিষয়টি নিয়ে সরকারের ভাবনা কী?
নুরুল ইসলাম: বিসিএস শিক্ষকেরা আনুষ্ঠানিকভাবে দাবিদাওয়া পেশ করার আগেই ধর্মঘট করলেন। ট্রেড ইউনিয়নও কিন্তু ধর্মঘটের আগে সরকারকে সময় বেঁধে দেয়। কিন্তু সরকারি শিক্ষকেরা ধর্মঘট করার আগে আমরা ভালোভাবে তাঁদের দাবিদাওয়া জানতে পারলাম না। পরে অবশ্য খোঁজখবর নিয়ে জানলাম, সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল না থাকায় তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। আমরা এ বিষয়টি নিয়েও মন্ত্রিসভা কমিটিতে আলোচনা করব।
প্রথম আলো: শিক্ষার অন্য স্তরের দাবিদাওয়াগুলোর কী হবে?
নুরুল ইসলাম: বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরাও গত জুলাই থেকে সরকারি চাকরিজীবীদের মতো জাতীয় বেতন স্কেলে বেতন পাবেন। তাঁদের মধ্যে এখন আর অসন্তুষ্টি নেই। প্রাথমিক শিক্ষকদের বিষয়গুলো প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় দেখবে। টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড না থাকায় সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষকদের যে সমস্যা হবে, তা নিয়েও পর্যালোচনা হচ্ছে।
প্রথম আলো: শিক্ষকদের প্রতি আপনার শেষ কথা কী?
নুরুল ইসলাম: শিক্ষা পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে শিক্ষকদের বলব, আমাদের কাজ করার সুযোগ দিন। আপনাদের দাবি পূরণে আমাদের সহযোগিতা করুন, পরামর্শ দিন। আমরাও চেষ্টা করছি, করে যাব। কিন্তু শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যান।
Published in: http://www.prothom-alo.com/opinion/article/641200

শিক্ষক, শিক্ষা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম

গোলাম ফারুক


বহুদিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। আমি নিজে ছাপোষা শিক্ষক বলে শিক্ষক-সম্পর্কিত ঘটনাটা ঠিকই মনে আছে। কোনো এক অজপাড়াগাঁয়ে এক হতভাগা শিক্ষক ছাত্র পড়ানোর কাজ পেলেন। ছাত্রদের বাগানের লাউটা-মুলাটা ছাড়াও পারিতোষিক হিসেবে সামান্য কিছু অর্থপ্রাপ্তি হতো বলে কষ্টেসৃষ্টে তাঁর দিন চলে যেত। এই স্বল্প বেতনটুকুও যে তিনি নিয়মিত পেতেন তা নয়, তবু ঘাড় গুঁজে নিষ্ঠার সঙ্গে তিনি তাঁর কাজ করে যাচ্ছিলেন।

কয়েক মাস ওঁর গোবেচারা স্বভাব লক্ষ করে গ্রামের বুদ্ধিমান মাতব্বরটির মনে হলো যে বেতন না দিয়েও তো ওঁকে দিয়ে বেগার খাটানো যায়। বেতন বন্ধ হলো। মাতব্বরটি যা ভেবেছিলেন তা-ই। তিনি প্রতিবাদ করেন না, যানও না। পেটেভাতে থাকেন আর ছাত্র পড়ান। এর বেশ কিছুদিন পর, বলা নেই কওয়া নেই, বাক্স-পেটরা নিয়ে একদিন তিনি হঠাৎ উধাও। তাতে যে কোনো ক্ষতি বৃদ্ধি হলো, তা নয়। চতুর মাতব্বর কয়েক দিনের মাথায় আরেকজন শিক্ষক জোগাড় করে ফেললেন। কিন্তু মাথায় হাত পড়ল সেদিন, যেদিন নতুন শিক্ষক দেখলেন, ছেলেমেয়েরা সব বর্ণমালা উল্টো করে লেখে। ওদের এভাবেই শেখানো হয়েছে; পুরোনো গোবেচারা শিক্ষকটি এভাবেই বেগার খাটানোর প্রতিশোধ নিয়ে গেছেন।

বেচারা শিক্ষকের প্রসঙ্গ আপাতত থাক। তার আগে ১৯৭০ দশকের সমাজতত্ত্ববিদ ওয়ালরস্টাইনের চোখ দিয়ে গোটা শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে অর্থনীতির সম্পর্কটা একটু ঝালিয়ে নিই। ওয়ালরস্টাইন বলেছেন, পৃথিবী তিন ভাগে বিভক্ত। সবচেয়ে শক্তিশালী অংশ হচ্ছে ‘সেন্টার’, যা গঠিত হয় উন্নত রাষ্ট্রগুলো দিয়ে। সবচেয়ে দুর্বল অংশ হচ্ছে ‘পেরিফেরি’, যেখানে দরিদ্র দেশগুলো অবস্থান করে। আর মাঝখানের জায়গাটা হচ্ছে ‘সেমি–পেরিফেরি’, যার প্রায় সব কটি রাষ্ট্র ‘পেরিফেরি’ থেকে উঠে এসে অনিবার্যভাবে যত দ্রুত সম্ভব ‘সেন্টারের’ দিকে অগ্রসর হচ্ছে।

এখন দেখা যাক, যে উন্নত রাষ্ট্রটি ‘সেন্টারে’ যায়, তা কীভাবে যায় বা টিকে থাকে। ওয়ালরস্টাইন বলছেন, তার আসল জোরটা শিক্ষায়, গবেষণায়, আবিষ্কারে। তারা এসব ক্ষেত্রে প্রভূত বিনিয়োগ করে বাজারে একেবারে আনকোরা নতুন পণ্য ছেড়ে একচেটিয়া ব্যবসা করে। একচেটিয়া ব্যবসার থলথলে মুনাফা ছাড়া ‘কেন্দ্রে’ টিকে থাকা যায় না। ফলে, নতুন পণ্যটির উৎপাদন-কলাকৌশল যখন জানাজানি হয়ে যায়, তখন তাদের আরেকটি পণ্য আবিষ্কার করতে হয়। সে জন্য সেখানে শিক্ষায় বিপুল বিনিয়োগ একটি অনিবার্য ও নিরন্তর প্রক্রিয়া।

উল্টো দিকে কিছু রাষ্ট্র ‘পেরিফেরিতে’ পড়ে থাকে, কারণ তাদের অদক্ষ শ্রম ও সামান্য কিছু প্রাকৃতিক সম্পদ ছাড়া বলতে গেলে আর কিছুই নেই। তবু এখান থেকে কিছু রাষ্ট্র যে ‘সেমি–পেরিফেরিতে’ যেতে পারে, তার কারণ তাদের শ্রমদক্ষতার উন্নয়ন। শ্রমদক্ষতার পূর্বশর্ত যেহেতু শিক্ষা, তাই যারাই ‘সেমি-পেরিফেরিতে’ গেছে বা যেতে চাইছে, তারাই সাধ্যমতো বা কখনো সাধ্যের বাইরে গিয়ে শিক্ষায় বিনিয়োগ করছে। যেমন: মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, কিউবা ইত্যাদি। এমনকি সৌদি আরবের মতো দেশ প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ থাকা সত্ত্বেও বাজেটের বৃহদংশ ব্যয় করে শিক্ষায়। এ তো গেল বাংলাদেশের চেয়ে যাদের জিডিপির আকার বড়, তাদের কথা। বাংলাদেশের চেয়ে দরিদ্র অনেক দেশও এ ব্যাপারে অনেক এগিয়ে গেছে। যেমন: উগান্ডা তার বাজেটের ১৬ শতাংশ, টোগো ১৭, বুরুন্ডি ২২, লেসেথো ২৪ ও তাঞ্জানিয়া ২৬ শতাংশ শিক্ষার জন্য ব্যয় করে। অথচ বাংলাদেশ, যা ২০২১ সালে ‘সেমি-পেরিফেরিতে’ ঢোকার আশা করে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ করেছে তার বাজেটের মাত্র ১০ দশমিক ৭ শতাংশ, যা জিডিপির ২ শতাংশ।

অবশ্য বাজেট বেশি হলেই যে শিক্ষা উন্নত হবে বা সে কারণে অর্থনীতি শক্তিশালী হবে, তার নিশ্চয়তা নেই। বিশ্বব্যাংকের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা–বিষয়ক এক প্রতিবেদনের ‘ইকোনমিক রিটার্নস টু ইনভেস্টমেন্ট ইন এডুকেশন’ অধ্যায়ে বলা হয়েছে, অনেক দেশেই শিক্ষা-বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক উন্নতির মধ্যে পজিটিভ কোরিলেশন পরিলক্ষিত হয়নি। এর কারণ, বিনিয়োগ হয়েছে শিক্ষার প্রসারে, মানে নয়। কোথাও হয়তো অনেক আয়োজন করে ছাত্রদের শুধু মুখস্থ করার দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু উন্নত চিন্তা-দক্ষতা বাড়ানোর সুযোগ সৃষ্টি করা হয়নি; কোথাও হয়তো ঝোঁকটা ছিল শুধু ছাত্রসংখ্যা বাড়ানোর দিকে, কিন্তু শিক্ষককুল রয়ে গেছেন আগের মতো অদক্ষ, অপ্রতুল, অবহেলিত, নিম্ন আয়ের ‘গোবেচারা’ আজ্ঞাবাহক।

বাংলাদেশ ২০২১ ও ২০৪১ সালে যথাক্রমে ‘সেমি–পেরিফেরি’ ও ‘সেন্টারে’ যাওয়ার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে সে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে এবং শিক্ষা-বিনিয়োগও বাড়াচ্ছে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, তা জিডিপির আকার অনুযায়ী বাড়ছে না। ২০০৯-১০ অর্থবছরে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ছিল বাজেটের ১৪ দশমিক ৬৭ শতাংশ, সেখান থেকে পরের বছর কমে হলো ১৩ দশমিক ৬১, তারপর ক্রমান্বয়ে ১৩ দশমিক ১৩, ১২ দশমিক ৩২, ১১ দশমিক ৫৮, ১১ দশমিক ৭ এবং সর্বশেষ এ বছর তা কমে দাঁড়ায় ১০ দশমিক ৭ শতাংশে। ফলে বলা যায়, অর্থনৈতিক অগ্রগতির তুলনায় শিক্ষায় বিনিয়োগ ক্রমাগত পিছিয়ে যাচ্ছে।

এখন কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, তাতে কী এমন ক্ষতি হচ্ছে? শিক্ষার যেটুকু উন্নতি হচ্ছে, তাতেই তো নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা পেয়েছে বাংলাদেশ। খাঁটি কথা। কিন্তু ভবিষ্যতে কি এই গতি ধরে রাখা যাবে? জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যাবে না। তাঁদের মতে, সন্তোষজনক অগ্রগতি চাইলে, অর্থাৎ একটি দেশের জনশক্তিকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে চাইলে তার জিডিপির ৬ শতাংশ বা বার্ষিক বাজেটের ২০ শতাংশ শিক্ষায় ব্যয় করা উচিত। এর কম হলেই যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে না তা নয়—বাংলাদেশ তার প্রমাণ—কিন্তু টেকসই উন্নয়ন চাইলে অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে সমান্তরালভাবেই শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।

এবার দেখা যাক জিডিপির যে সামান্য অংশ বাংলাদেশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ করে, তা সঠিকভাবে ব্যয় হচ্ছে কি না। সুখের কথা, অনেকটাই হচ্ছে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা ‘যুগান্তকারী’ পরিবর্তন আনতে পারে বললেও ভুল হবে না। যেমন: শিক্ষানীতি প্রণয়ন, কারিকুলামের আধুনিকায়ন ও নতুন পাঠ্যপুস্তক তৈরি, বিনা মূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ, সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি প্রবর্তন, ডিজিটাল ক্লাসরুম স্থাপন, ই-বুক প্রণয়ন, নারীশিক্ষার প্রসার, মাদ্রাসাশিক্ষা আধুনিকীকরণ, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ইত্যাদি। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি, যা না হলে উপর্যুক্ত সব অর্জনই শেষ পর্যন্ত অর্থহীন হয়ে পড়বে, সেই শিক্ষকদের বেতন-মান-মর্যাদা বৃদ্ধির কথা নিয়ে সরকার তেমন কিছু করছে না। অবশ্য একেবারে ভাবছে না বললে ভুল হবে। শিক্ষামন্ত্রী বারবারই এ প্রসঙ্গ তোলেন, কিন্তু বাজেটে তার প্রতিফলন ঘটে না।

শিক্ষকদের বেতন-মান-মর্যাদা বৃদ্ধি না হলে শিক্ষাক্রমের আধুনিকায়ন যে কার্যকর হয় না, তার অন্তত দুটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। যেমন ইংরেজি শিক্ষার ক্ষেত্রে কমিউনিকেটিভ অ্যাপ্রোচ চালু এবং প্রশ্নের ক্ষেত্রে সৃজনশীল পদ্ধতি প্রবর্তন—এই চমৎকার উদ্যোগগুলো উপযুক্ত শিক্ষকের অভাবে শুধু যে মাঠে মারা যাচ্ছে তা নয়, শিখন-শেখানোর প্রক্রিয়াতেও তা বিরূপ প্রভাব ফেলছে। এ কথা এখন প্রায় কেউই অস্বীকার করেন না যে বাংলাদেশে শিক্ষার ‘প্রসার’ সন্তোষজনক। কিন্তু ‘মান’ নিয়ে যে দ্বিমত আছে, তা এ কারণেই। শিক্ষকেরা ক্লাসে পড়াতে পারছেন না, এমনকি ঠিকমতো প্রশ্নও করতে পারছেন না, ফলে দায় এড়ানোর জন্য পরীক্ষার খাতায় বেশি বেশি নম্বর দিয়ে ছাত্রদের খুশি করে নিজেরা নিরাপদে থাকছেন।

শিক্ষাক্ষেত্রে যেসব উল্লেখযোগ্য সাফল্য ইতিমধ্যে অর্জিত হয়েছে, তা অর্জন করতে শিক্ষকদের সাহায্যের প্রয়োজন হয়নি। এসব কাজ আমলা, দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবী বা বিদেশি কনসালট্যান্টরাই করেছেন। কিন্তু এর পরের ধাপ—শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন, নতুন পাঠ্যবই পড়ানো, সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরি করা, আধুনিক পদ্ধতিতে পাঠদান করা—তো শিক্ষকদেরই বাস্তবায়ন করতে হবে। সেখানেই সমস্যা। কম বেতনে, বিনা পুরস্কারে এবং নামমাত্র প্রশিক্ষণ নিয়ে ক্লাস উপচে পড়া ছাত্রছাত্রীদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা অপ্রণোদিত শিক্ষকদের পক্ষে একেবারে অসম্ভব না হলেও দুরূহ তো বটেই।

শিক্ষকদের এই বেহাল অবস্থা নতুন নয়। প্রায় সব দেশে শিক্ষকেরা চিরকালই অবহেলার শিকার হয়েছেন। কারণ, শিক্ষা কখনো সরাসরি উৎপাদনশীল খাত বলে বিবেচিত হতো না। যখন থেকে জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির ধারণা জনপ্রিয় হলো বা শিক্ষা আধুনিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্র উন্নয়নের অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়াল, তখন থেকে রাষ্ট্রগুলো শিক্ষাব্যবস্থার মেরুদণ্ডে (শিক্ষকদের) গুরুত্ব দেওয়া শুরু করল। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, উন্নত ও সত্যিকার অর্থে উন্নয়নপিপাসু প্রায় সব দেশ গত কয়েক দশকে শিক্ষকদের বেতন-মান-মর্যাদা প্রায় কয়েক গুণ বৃদ্ধি করেছে। বাংলাদেশ সরকারও যে তা উপলব্ধি করেনি তা নয়, কিন্তু হয় অর্থাভাবে বা অন্য কোনো অজানা কারণে তা বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না।

কিন্তু যেভাবেই হোক, শিক্ষকদের বেতন-মান-মর্যাদা বাড়াতেই হবে। দারিদ্র্য ও অবহেলায় পীড়িত, কুণ্ঠিত, ন্যুব্জদেহ এই শিক্ষককুলের পক্ষে সরকার-পরিকল্পিত আধুনিক শিক্ষার গুরুভার বহন করা সম্ভব নয়। তাঁরা হয়তো জোরেশোরে এর প্রতিবাদ করবেন না। কিন্তু গল্পের সেই ‘গোবেচারা’ শিক্ষকের মতো ক্লাসে না পড়িয়ে, খাতা না দেখে কেবল সোজা প্রশ্ন করে এবং বেশি বেশি নম্বর দিয়ে ছাত্রদের পাস করিয়ে দেবেন—অথর্ব প্রজন্ম তৈরি করে, ইচ্ছায় হোক কিংবা অনিচ্ছায়, নীরবে, নিভৃতে এক নিষ্ঠুর প্রতিশোধ নিয়ে নেবেন।

সবাইকে লক্ষ রাখতে হবে যে এই প্রলয়ংকরী ঘটনা যেন না ঘটে। শিক্ষকেরা যেন মনপ্রাণ দিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে তোলার সুযোগ ও প্রণোদনা পান। একমাত্র তাঁদের তৈরি শিক্ষিত দক্ষ জনশক্তিই বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে পারে।

গোলাম ফারুক: ফলিত ভাষাতত্ত্ববিদ, গবেষক, অধ্যাপক।
faruk.golam@yahoo.com

Published in: http://prothom-alo.com/opinion/article/640813/

আরো পড়ুনঃ "স্বতন্ত্র স্কেল চাই, অন্য কোন দাবি নাই!!"

শিক্ষায় ভ্যাট সংবিধান ও শিক্ষানীতি পরিপন্থী

মো. আবুসালেহ সেকেন্দার

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ফলে টিউশন ফিতে ভ্যাট প্রদানের সরকারি সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়েছে। তবে এখনো ইংরেজি মাধ্যম বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের ভ্যাট প্রদান করতে হয়। যদিও অতিসম্প্রতি উচ্চ আদালতে একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত আগামী ছয় মাসের জন্য ভ্যাট আদায় স্থগিত করেছেন। উচ্চ আদালতের ওই আদেশ শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের পথ রুদ্ধ করবে বলে আমাদের মনে হয়। পাশাপাশি সরকারও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোই ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার্থীদের টিউশন ফির ওপর থেকে ভ্যাট আদায়ের সিদ্ধান্ত বাতিল করবে। শিক্ষাকে পণ্য বিবেচনা করে ভবিষ্যতেও যেন কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অথবা শিক্ষার যেকোনো পর্যায়ে বা মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের টিউশন ফির ওপর ভ্যাট আরোপ না করা হয়, সে বিষয়ে উদ্যোগী হবে।

শিক্ষায় ভ্যাট আরোপের বিষয়টি বাংলাদেশের সংবিধান, শিক্ষানীতি, শিক্ষা আইন, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার, গঠনতন্ত্র ও লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, আওয়ামী লীগের আন্দোলনের ইতিহাস অথবা ১৪ দলের অন্য দলের গঠনতন্ত্র ও প্রধানমন্ত্রীর জাতিসংঘে বক্তব্য পরিপন্থী। আর শিক্ষায় ভ্যাট আদায় কর আইনও অনুমোদন করে না। মূল্য সংযোজন কর আইন ১৯৯১ মতে, মূল্য সংযোজন কর প্রদান করবেন— ক. আমদানিকৃত পণ্যের ক্ষেত্রে, আমদানি পর্যায়ে আমদানিকারক; খ. বাংলাদেশে প্রস্তুতকৃত বা উত্পাদিত পণ্যের ক্ষেত্রে, প্রস্তুতকরণ বা উত্পাদন পর্যায়ের সরবরাহকারী; গ. সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে, সেবা প্রদানকারী; এবং ঘ. বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমারেখার বাইরে থেকে সেবা সরবরাহের ক্ষেত্রে, সেবা গ্রহণকারী; এবং ঙ. অন্যান্য ক্ষেত্রে, সরবরাহকারী ও সেবাগ্রহণকারী। ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এর কোনো খাতে পড়ে না। ফলে শিক্ষার্থীর টিউশন ফির ওপর ভ্যাট আরোপের বিষয়টি কর আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

দ্বিতীয়ত. কর আইনে স্পষ্টত পণ্য থেকে কর আদায়ের বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা শিক্ষা গ্রহণ করেন। আর শিক্ষা কোনো পণ্য নয়। কারণ শিক্ষার্থীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা ক্রয় করেন না। তারা শিক্ষা অর্জন করেন। ওই অর্জনে তাদের পরিশ্রম করতে হয়। মেধা ও যোগ্যতার প্রমাণ রাখতে হয়। পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হওয়ার পরই কেবল তারা সনদপত্র লাভ করেন। তারা অর্থ প্রদান করছেন বলেই সনদ পাচ্ছেন, বিষয়টি এমন নয়। কিন্তু শিক্ষা যদি পণ্য হতো, তবে শিক্ষার্থীদের পরিশ্রম করতে অথবা মেধা ও যোগ্যতার প্রমাণ রাখতে হতো না। তাদের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ ও পাসের কোনো প্রশ্ন আসত না। তারা বাজারে যেমন টাকার বিনিময়ে আলু-পটোল কিনতে পারেন, তেমনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে টাকা দিয়ে শিক্ষা তথা সনদপত্র ক্রয় করতেন।

সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদে স্পষ্টতই বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হবে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশের মাধ্যমে উত্পাদন শক্তির ক্রমবৃদ্ধিসাধন এবং জনগণের জীবনযাত্রার বস্তুগত ও সংস্কৃতিগত মানের দৃঢ় উন্নতি সাধন। আর এর মাধ্যমে রাষ্ট্র নাগরিকের অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিত্সার ব্যবস্থা করবে।’ সংবিধান অনুসারে রাষ্ট্রের দায়িত্ব ছিল প্রত্যেক নাগরিকের জন্য মৌলিক অধিকার শিক্ষা গ্রহণের বিষয়টি নিশ্চিত করা। কিন্তু রাষ্ট্র তার সেই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে বলেই ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীর অভিভাবকরা রাষ্ট্রের সেই দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছেন। অভিভাবকরা টাকার বিনিময়ে তার সন্তানের জন্য জামাকাপড় ক্রয় করেন, এক্ষেত্রে শিক্ষা বা সনদ ক্রয় করছেন বিষয়টি এমন নয়। বরং এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা গ্রহণের জন্য যে খরচ রাষ্ট্রের বহন করার কথা ছিল, তারা সেই খরচ বহন করছেন মাত্র। আর যেহেতু শিক্ষার্থী বা অভিভাবকরা ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে কিছু ক্রয় করছেন না, সেহেতু কর আইন অনুযায়ী তাদের ওপর ভ্যাট ধার্য করার কোনো সুযোগ নেই।

যদিও সরকারের পক্ষ থেকে যুক্তি উত্থাপন করা হতে পারে যে, ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো লাভজনক প্রতিষ্ঠান। ফলে তাদের কাছ থেকে ভ্যাট আদায় করা যেতে পারে। কিন্তু ভ্যাট আইন অনুসারে কেবল পণ্যের ওপরই ভ্যাট প্রযোজ্য হবে। তাই যদি ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীর টিউশন ফির ওপর ভ্যাট আরোপ করা হয়, তবে তা শিক্ষাকে পণ্যে পরিণত করে। আর কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরই শিক্ষাকে পুঁজি করে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়ার সুযোগ নেই। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অধ্যায়ের ৮ অনুচ্ছেদ শিক্ষাকে পণ্যে পরিণত করার বিষয়টি অনুমোদন করে না। ওই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘বৈষম্যহীন সমাজ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে মেধা ও প্রবণতা অনুযায়ী স্থানিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক নির্বিশেষে সকলের জন্য শিক্ষা লাভের সমান সুযোগ অবারিত করা। শিক্ষাকে মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে পণ্য হিসেবে ব্যবহার না করা।’ জাতীয় শিক্ষানীতি শিক্ষাকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করার বিষয়টি অনুমোদন না করায় ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো লাভ করছে— এমন অজুহাত তুলে শিক্ষার্থীর টিউশন ফির ওপর ভ্যাট আদায় করার কোনো সুযোগ নেই। আর এমনটি যদি অব্যাহত থাকে অর্থাত্ টিউশন ফির ওপর ভ্যাট আরোপ অব্যাহত রাখা হয়, তবে তা বর্তমান সরকার প্রণীত শিক্ষানীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বিরোধী কাজ। এরূপ দ্বিমুখী নীতি বর্তমান সরকারের শিক্ষায় সাফল্য লাভের বিষয়টিকে কলঙ্কিত করবে। বর্তমান সরকার শিক্ষাবান্ধব এমন প্রচারণাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে। তাই সরকারের উচিত হবে অচিরেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের টিউশন ফির ওপর থেকে ভ্যাট আদায়ের সিদ্ধান্তটি বাতিল করা।

সরকারের দায়িত্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করছে কিনা, তা তদারক করা। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ পরিপন্থী কাজ পরিচালনা করে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যাতে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত না হতে পারে, সে বিষয়টি নিশ্চিত করা। কিন্তু সরকার সেই দায়িত্ব পালন না করে ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো মুনাফা করছে অজুহাত তুলে টিউশন ফির ওপর ভ্যাট আরোপ করে, তবে জাতীয় শিক্ষা নীতি ২০১০-এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা ও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে যতটুকু অর্থ প্রয়োজন, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সেই টাকাই টিউশন ফি হিসেবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো গ্রহণ করছে কিনা, তা নিশ্চিত করার দায়িত্বও সরকারের। কিন্তু সরকার সেই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়ে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ‘ব্যবসা করছে’, ‘লাভ করছে’ অজুহাত তুলে শিক্ষার্থীদের টিউশন ফির ওপর ভ্যাট আরোপের সিদ্ধান্তে অনড় থাকে। তবে তা কোনোভাবে সমর্থনযোগ্য নয়। এর মাধ্যমে সমাজে যারা আইন অমান্য করছে, তারা উত্সাহিত হবে। এমনো হতে পারে ভবিষ্যতে সরকার ইয়াবা বা ফেনসিডিল আমদানি বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়ে কাজটিকে বৈধতা দিতে তার ওপর ভ্যাট আরোপ করবে! কিন্তু সরকার একটি অন্যায় কাজ প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হয়ে অন্য একটি অনৈতিক কাজের মাধ্যমে ওই কাজের বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করলে তা কোনোভাবেই নাগরিক সমাজের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না।

ভ্যাট আদায় না করে কোনো ইংরেজি মাধ্যম স্কুল বা কলেজ কত লাভ করছে, তার তালিকা প্রকাশ করা হোক, যাতে শিক্ষার্থীরা সত্য জানতে পারে। পাশাপাশি সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে আইন মেনে যতটুকু অর্থ ব্যয় নির্বাহে প্রয়োজন, ততটুকুই শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করতে বাধ্য করা হোক। আর এভাবে যদি আইনের যথার্থ প্রয়োগ করা যায়, তবে ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীদের ওপর যে বিশাল অঙ্কের টিউশন ফির বোঝা চেপে বসেছে, তা থেকে তারা মুক্তি পাবে। অভিভাবকরা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে পারবেন।

ইংরেজি মাধ্যমে বিত্তশালী পরিবারের সন্তানরা পড়ে এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরাও ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ছে। ইংরেজি মাধ্যমে পড়া শিক্ষার্থীদের দেশের বাইরে যাওয়ার সহজ সুযোগ থাকায় এবং কর্মসংস্থান সহজ হওয়ায় মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানরাও সেখানে পড়ে। অনেক শিক্ষার্থীর পরিবার অনেক কষ্ট করে অথবা অভিভাবকরা অন্য কোনো খণ্ডকালীন কাজে নিযুক্ত হয়ে নিজ সন্তানের সুশিক্ষা নিশ্চিত করতে অতিরিক্ত অর্থ আয়ের মাধ্যমে টিউশন ফি প্রদান করেন।

সংবিধানমতে, এসব শিক্ষার্থীর শিক্ষার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব ছিল রাষ্ট্রের। কিন্তু সরকার বা রাষ্ট্র যখন সেই দায়িত্ব পালনে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে, তখন ওই শিক্ষার্থী বা তার অভিভাবকরা রাষ্ট্র বা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেননি, বরং নীরবে রাষ্ট্রের ওই ব্যর্থতাকে মেনে নিয়ে নিজেরাই নিজেদের বা সন্তানের শিক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। রাষ্ট্র বা সরকারের উচিত ছিল ওই অদম্য অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের সাধুবাদ জানানো। সহজ শর্তে শিক্ষায় ঋণসহ নানা সুযোগ সুবিধা প্রদান করা। কিন্তু উল্টো তাদের চলার পথ আরো কণ্টকাকীর্ণ করতে ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে, যা কোনো যুক্তিতে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তাই সংবিধান, শিক্ষানীতিবিরোধী শিক্ষায় ভ্যাট প্রত্যাহার করার জোর দাবি জানাচ্ছি। পাশাপাশি যদি কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ অমান্য করে শিক্ষাকে পণ্যে পরিণত করে লাভজনক ব্যবসায় নিয়োজিত হয়, তবে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।


লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় salah.sakender@gmail.com 

Published in: http://www.bonikbarta.com/news/details/50743.html